সমাস
‘সমাস’ শব্দের অর্থ সংক্ষেপণ, মিলন, একাধিক পদের একপদীকরণ। শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়, সম্ + অস্ = সমাস। বাক্যে শব্দের ব্যবহার সংক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে সমাসের সৃষ্টি হয়। সমাস দ্বারা দুই বা ততোধিক শব্দের সমন্বয়ে নতুন অর্থবোধক পদ সৃষ্টি হয়। এভাবে বলা যায়, পরস্পর অর্থ সঙ্গতিবিশিষ্ট দুই বা ততোধিক পদের একপদে পরিণত হওয়াই সমাস। এই রীতি সংস্কৃত ভাষা থেকে আগত।
উদাহরণ: তুষারের মতো ধবল = তুষারধবল।
ব্যাখ্যা: উপরিউক্ত “তুষারের মতো ধবল”– এই শব্দগুচ্ছ দ্বারা "ধবল" বা "সাদা" রংকেই বোঝানো হয়েছে। তবে শুধু "সাদা" বললে জানতে ইচ্ছে হয় — কিসের মতো সাদা? ফলে সাধারণত আমরা ‘তুষার’ শব্দটির সাথে ‘ধবল’ শব্দটির একটি সম্পর্ক রেখে, মধ্যের ‘মতো’ শব্দটি বাদ দিয়ে “তুষারধবল” নতুন শব্দটি ব্যবহার করি। এতে প্রকৃত অর্থ স্পষ্ট হয় এবং ভাব প্রকাশও শক্তিশালী হয়। এভাবে শব্দ গঠনের প্রক্রিয়াকে সমাস বলা হয়।
সমাসের প্রয়োজনীয়তা
বাংলা ভাষায় শব্দ গঠনে সমাসের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, সমাস শব্দ তৈরি ও প্রয়োগের একটি নির্দিষ্ট রীতি, যার মাধ্যমে দুই বা ততোধিক শব্দের সমন্বয়ে নতুন অর্থবোধক পদ সৃষ্টি করা যায়। এর ফলে ভাষা সহজ, সুন্দর এবং সংক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, “ঘরে আশ্রিত জামাই” বলার পরিবর্তে ‘ঘরজামাই’ ব্যবহার করলে বাক্যটি সংক্ষিপ্ত, প্রাঞ্জল ও শ্রুতিমধুর হয়। নতুন শব্দ সৃষ্টির মাধ্যমে ভাষার ঐশ্বর্য ও প্রকাশ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, যা সাহিত্য নির্মাণ ও পরিভাষা সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
সমাসের বিভিন্ন পরিভাষা
ব্যাসবাক্য | সমাস | ||
---|---|---|---|
সিংহ | চিহ্নিত যে | আসন | সিংহাসন |
সমস্যমান পদ |
সমস্যমান পদ |
সমস্যমান পদ |
সমস্তপদ |
পূর্বপদ | মধ্যপদ | পরপদ |
সমস্যমান পদ
যে যে পদে সমাস ঘটে, তাদের প্রত্যেকটিকে সমস্যমান পদ বলা হয়। যেমন: ধানের ক্ষেত = ধানক্ষেত। এখানে ‘ধানের’ ও ‘ক্ষেত’—উভয়েই সমস্যমান পদ।
সমস্ত পদ
সমাসবদ্ধ বা সমাস নিষ্পন্ন পদকে সমস্তপদ বলে। যেমন: সিংহ চিহ্নিত আসন = সিংহাসন, যেখানে ‘সিংহাসন’ একটি সমস্তপদ।
ব্যাসবাক্য বা বিগ্রহ বাক্য
সমাসের অর্থ বোঝানোর জন্য যে পদগুলোকে ব্যাখ্যা করা হয়, তাদেরকে ব্যাসবাক্য বা বিগ্রহ বাক্য বলা হয়। যেমন: ঘরে আশ্রিত জামাই = ঘরজামাই; এখানে “ঘরে”, “আশ্রিত” ও “জামাই” কথাগুলো ব্যাসবাক্য।
পূর্বপদ ও উত্তরপদ/পরপদ
সমাসবদ্ধ পদে প্রথম অংশকে পূর্বপদ এবং দ্বিতীয় বা পরবর্তী অংশকে উত্তরপদ বা পরপদ বলা হয়। যেমন: কুসুমের মতো কোমল = কুসুমকোমল; এখানে ‘কুসুম’ পূর্বপদ এবং ‘কোমল’ উত্তরপদ/পরপদ।
সমাসের বৈশিষ্ট্যাবলি
‘সমাস’ শব্দ তৈরি ও প্রয়োগের একটি বিশেষ রীতি, যার বৈশিষ্ট্যসমূহ নীচে তুলে ধরা হলো:
- সমাস দ্বারা নতুন নতুন শব্দ গঠন করে বাংলা ভাষার শব্দ-সম্ভারকে সমৃদ্ধ করা যায়।
- সমাসে পরস্পর অর্থসঙ্গতিবিশিষ্ট দুই বা ততোধিক পদ একপদে পরিণত হয়।
- সমাস-সাধিত শব্দ সংক্ষিপ্ত ও শক্তিশালী ভাব প্রকাশে সক্ষম।
- সমাসের রীতি সংস্কৃত ভাষা থেকে আগত।
সন্ধি ও সমাসের পার্থক্য
বাংলা ভাষায় নতুন শব্দ গঠনে সন্ধি ও সমাসের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। যদিও উভয়ের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য আছে, তবে এদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। নিচে এই বৈসাদৃশ্যগুলো তুলে ধরা হলো:
বিষয় | সন্ধি | সমাস |
---|---|---|
অর্থ | 'সন্ধি' শব্দের অর্থ হলো মিলন। | 'সমাস' শব্দের অর্থ হলো সংক্ষেপণ। |
সংজ্ঞা | সন্ধি হলো পাশাপাশি দুটি ধ্বনি বা বর্ণের মিলন। উদাহরণ: অতি + অন্ত = অত্যন্ত। |
সমাস হলো একাধিক পদের একপদে মিলন। উদাহরণ: বিলাত হতে ফেরত = বিলাতফেরত। |
আলোচনা | সন্ধি আলোচিত হয় ধ্বনিতত্ত্বে। | সমাস আলোচিত হয় রুপতত্ত্বে। |
লক্ষ্য | সন্ধির লক্ষ্য বর্ণের মিলন, অর্থের সাথে তেমন সম্পর্ক নেই। | সমাসের লক্ষ্য পদের মিলন, এটি অর্থের সাথে সম্পর্কিত। |
বিভক্তি | সন্ধিতে পদের বিভক্তি লোপ পায় না। | সমাসে (অলুক সমাস ব্যতীত) প্রতিটি পদের বিভক্তি লোপ পায়। |
প্রভাব | সন্ধি উচ্চারণের কাঠিন্য দূর করে ও লঘুতা সৃষ্টি করে। | সমাস বাক্যকে সংক্ষেপ করে ও শ্রুতিমধুরতা বৃদ্ধি করে। |
স্বকীয়তা | সন্ধিতে পদের স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকে। | সমাসে পদগুলো একপদের মধ্যে হারিয়ে যায়। |
চিহ্ন | সন্ধিতে দুই বর্ণের মাঝে যোগ চিহ্ন (+) ব্যবহার করতে হয়। | সমাসে দুই পদের মাঝে সাধারণত অব্যয় পদ ব্যবহৃত হয়। |
প্রকারভেদ | সন্ধি প্রধানত তিন প্রকার: স্বরসন্ধি, ব্যঞ্জনসন্ধি, বিসর্গসন্ধি। |
সমাস প্রধানত ছয় প্রকার: দ্বন্দ্ব, দ্বিগু, বহুব্রীহি, কর্মধারয়, তৎপুরুষ, অব্যয়ীভাব। |
সমাসের প্রকারভেদ
বাংলা ভাষার সমাসবদ্ধ পদগুলোতে কখনো পূর্বপদের, কখনো পরপদের কিংবা উভয়ের অর্থ প্রাধান্য পায়। তদুপরি, কখনো পূর্বপদ-উত্তরপদের পাশাপাশি তৃতীয় অর্থও প্রকাশ পায়। এ বিচারে কিছু ব্যাকরণবিদ তৎপুরুষ সমাসের অন্তর্ভুক্তি হিসেবে দ্বিগু ও কর্মধারয় সমাসকে একত্রে গণ্য করেছেন। তবে প্রচলিত নিয়মানুসারে নীচে ছয় ধরনের সমাস আলোচনা করা হয়েছে:
১. দ্বন্দ্ব সমাস
দ্বন্দ্ব সমাসে সমস্যমান পদ দুটিরই অর্থ সমানভাবে বিবেচিত হয়। উদাহরণ: মা-বাবা, হাত-পা, বই-খাতা।
২. কর্মধারয় সমাস
কর্মধারয় সমাসে বিশেষণ ও বিশেষ্য পদের সমাস হয়, যেখানে পরপদের অর্থ প্রধান। উদাহরণ: নীল আকাশ, সুন্দর ফুল।
৩. তৎপুরুষ সমাস
তৎপুরুষ সমাসে পরপদের অর্থ প্রধান হয় এবং পূর্বপদের বিভক্তি লোপ পায়। উদাহরণ: রামের বাণ = রামবাণ, গাছের পাতা = গাছপাতা।
৪. বহুব্রীহি সমাস
বহুব্রীহি সমাসে সমস্যমান পদগুলোর অর্থ বাদ দিয়ে একটি তৃতীয় অর্থ প্রকাশ করা হয়। উদাহরণ: পীত (হলুদ) অম্বর (বস্ত্র) যার = পীতাম্বর (যার বস্ত্র হলুদ রঙের)। ("পীতাম্বর" শব্দটি অনেক সময় কৃষ্ণ বা বিষ্ণুকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়)
৫. দ্বিগু সমাস
দ্বিগু সমাসে সংখ্যাবাচক শব্দের সাথে অন্য শব্দের সমাস হয়। উদাহরণ: তিনপুরুষ, চৌরাস্তা।
৬. অব্যয়ীভাব সমাস
অব্যয়ীভাব সমাসে অব্যয় পদের সাথে অন্য পদের সমাস হয় এবং পূর্বপদের অর্থ প্রধান। উদাহরণ: বিনা অন্ন = অনন্ন, প্রতি দিন = প্রতিদিন।
সমাস | অর্থপ্রাধান্য |
---|---|
অব্যয়ীভাব | পূর্বপদ |
তৎপুরুষ, কর্মধারয়, দ্বিগু | পরপদ |
দ্বন্দ্ব | উভয় পদ |
বহুব্রীহি | অন্য পদ |
দ্বন্দ্ব সমাস
ও এবং আর, দ্বন্দ্ব নাম তার |
সমজাতীয় পদ + ও + সমজাতীয় পদ |
'দ্বন্দ্ব' শব্দের অর্থ জোড়া। যে সমাসে প্রত্যেকটি সমস্যমান পদে অর্থের প্রাধান্য থাকে এবং কেউ কারও দ্বারা সঙ্কুচিত হয় না, তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমন—জীবন ও মরণ = জীবন-মরণ, পোকা ও মাকড় = পোকা-মাকড়, সাত ও সতেরো = সাত-সতেরো, গমন ও আগমন = গমনাগমন।
দ্বন্দ্ব সমাসের শ্রেণীবিভাগ
১. মিলনার্থক দ্বন্দ্ব
যে দ্বন্দ্ব সমাসে সমস্যমান পদগুলোর মধ্যে অভিন্ন সম্পর্ক থাকে, তাকে মিলনার্থক দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমন—
- ছেলে ও মেয়ে = ছেলে-মেয়ে
- পিতা ও পুত্র = পিতা-পুত্র
- মাছ ও ভাত = মাছ-ভাত
- ভাই ও বোন = ভাই-বোন
- জিন ও পরী = জিন-পরী
২. বিরোধার্থক দ্বন্দ্ব
যে দ্বন্দ্ব সমাসে পরপদটি পূর্বপদের বৈরী অর্থ বা ভাব প্রকাশ করে, তাকে বিরোধার্থক দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমন—
- অহি ও নকুল = অহি-নকুল
- দা ও কুমড়া = দা-কুমড়া
- স্বর্গ ও নরক = স্বর্গ-নরক
- দেও ও দানব = দেও-দানব
৩. সমার্থক দ্বন্দ্ব
একই জাতীয় বস্তুর সংযোগে যে দ্বন্দ্ব সমাস হয়, তাকে সমার্থক দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমন—
- হাট ও বাজার= হাট-বাজার
- বই ও পুস্তক = বই-পুস্তক
- চিঠি ও পত্র = চিঠি-পত্র
- ঘর ও বাড়ি = ঘর-বাড়ি
- জন ও মানব = জনমানব
৪. বিপরীতার্থক দ্বন্দ্ব
যে দ্বন্দ্ব সমাসে পরপদটি পূর্বপদের বিপরীত অর্থ প্রকাশ করে, তাকে বিপরীতার্থক দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমন—
- ছোট ও বড় = ছোট-বড়
- জমা ও খরচ = জমা-খরচ
- দেশ ও বিদেশ = দেশ-বিদেশ
- সত্য ও মিথ্যা = সত্য-মিথ্যা
- আয় ও ব্যয় = আয়-ব্যয়
- জোয়ার ও ভাটা = জোয়ার-ভাটা
- আকাশ ও পাতাল = আকাশ-পাতাল
- হিত ও অহিত = হিতাহিত
৫. সংখ্যাবাচক দ্বন্দ্ব
যে দ্বন্দ্ব সমাসে উভয় পদের দ্বারা সংখ্যা বোঝায়, তাকে সংখ্যাবাচক দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমন—
- বিশ ও পঁচিশ = বিশ-পঁচিশ
- লক্ষ অথবা কোটি = লক্ষ-কোটি
- সাত ও সতের = সাত-সতের
- সাত ও পাঁচ = সাত-পাঁচ
Confusion Alert: সংখ্যাবাচক দ্বন্দ্বে উভয় পদের অর্থই প্রাধান্য পায় এবং উভয় পদই সংখ্যা(বিশেষ্য) হয়। কিন্তু সংখ্যাবাচক বহুব্রীহিতে পূর্বপদ এবং পরপদ কোনটির অর্থ না বুঝিয়ে অন্য কোন তৃতীয় অর্থ প্রকাশ করে। যেমন, দশ গজ পরিমাণ — দশগজি। এই দশগজি দ্বারা দশগজ পরিমাণ কোন একটি বস্তুকে বোঝাচ্ছে। তাই এটি সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি। এরকম আরো-চৌচালা,চারহাতি,পঞ্চানন ইত্যাদি।
৬. সহচর দ্বন্দ্ব
যে দ্বন্দ্ব সমাসে পরপদটি পূর্বপদের সহচর হিসেবে যুক্ত হয়, তাকে সহচর দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমন—
- সর্দি ও কাশি = সর্দি-কাশি
- খানা ও পিনা = খানা-পিনা
- বন ও বাদাড় = বন-বাদাড়
- ছল ও চাতুরী = ছল-চাতুরী
- ধর ও পাকড় = ধর-পাকড়
- কাপড় ও চোপড় = কাপড়-চোপড়
- পোকা ও মাকড় = পোকা-মাকড়
- চুরি ও চামারি = চুরি-চামারি
- হৈ ও হল্লা = হৈ-হল্লা
- ধুতি ও চাদর = ধুতি-চাদর
৭. বহুপদী দ্বন্দ্ব
যে দ্বন্দ্ব সমাসে দুয়ের অধিক পদের মধ্যে সমাস হয়, তাকে বহুপদী দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমন—
- সাহেব বিবি ও গোলাম = সাহেব-বিবি-গোলাম
- জন্ম, মৃত্যু আর বিবাহ = জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ
- রূপ, রস, গন্ধ ও স্পর্শ = রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ
- চন্দ্ৰ, সূর্য, গ্রহ ও নক্ষত্র = চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র
- ইট, কাঠ ও পাথর = ইট-কাঠ-পাথর
- টাকা, আনা ও পাই = টাকা-আনা-পাই
- চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য ও পেয় = চর্ব্যচোষ্যলেহ্যপেয়
- স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল = স্বর্গমর্ত্যপাতাল
- কায়(দেহ), মন ও বাক্য = কায়মনোবাক্য
৮. একশেষ দ্বন্দ্ব
যে দ্বন্দ্ব সমাসে প্রধান পদটি অবশিষ্ট থাকে ও অন্য পদগুলো লোপ পায় এবং শেষ পদ অনুসারে শব্দ নির্ধারিত হয়, তাকে একশেষ দ্বন্দ্ব সমাস বলা হয়। যেমন—
- তুমি, সে ও আমি = আমরা
- জায়া ও পতি = দম্পতি
৯. অলুক দ্বন্দ্ব
যে দ্বন্দ্ব সমাসে কোন সমস্যমান পদের বিভক্তি লোপ পায় না, তাকে অলুক দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমন—
- দুধে ও ভাতে = দুধে-ভাতে
- হাতে ও কলমে = হাতে-কলমে
- পথে ও ঘাটে = পথে-ঘাটে
- দেশে ও বিদেশে = দেশে-বিদেশে
- জলে ও স্থলে = জলে-স্থলে
এরূপ: সাপে-নেউলে[১], পথে-প্রান্তরে[২], হেসে-খেলে[৩], বনে-বাঁদাড়ে[৪] ইত্যাদি।
দ্বন্দ্ব সমাসের গঠন
বিভিন্নভাবে দ্বন্দ্ব সমাস গঠিত হয়। যেমন:
১. মিলনার্থক শব্দযোগে: | মা-বাপ, মাসি-পিসি,ভাই-বোন, জ্বিন-পরি, দীন-দুঃখী, চা-বিস্কুট, চাল-ডাল |
২. বিরোধার্থক শব্দযোগে: | চোর-পুলিশ, দা-কুমড়া, অহি-নকুল, স্বর্গ-নরক ইত্যাদি |
৩. বিপরীতার্থক শব্দযোগে: | আয়-ব্যয়, জমা-খরচ, ছোট-বড়, ছেলে-বুড়ো, লাভ-লোকসান, দিন-রাত, শত্রু-মিত্র, রাজা-প্রজা, জন্ম-মৃত্যু, সৎ-অসৎ, পাপ-পুণ্য |
৪. অঙ্গবাচক শব্দযোগে: | হাত-পা, নাক-কান, বুক-পিঠ, মাথা-মুণ্ডু, নাক-মুখ, চোখ-কান |
৫. সংখ্যাবাচক শব্দযোগে: | সাত-পাঁচ, নয়-ছয়, সাত-সতের, উনিশ-বিশ |
৬. সমার্থক শব্দযোগে: | হাট-বাজার, কল-কারখানা, মোল্লা-মৌলভি, খাতা-পত্র, রাজা-বাদশা, ধন-দৌলত, বই-পুস্তক, ছাইভষ্ম, দয়া-মায়া, পাহাড়-পর্বত |
৭. প্রায় সমার্থক ও সহচর শব্দযোগে: | কাপড়-চোপড়, পোকা-মাকড়, দয়া-মায়া, ধূতি-চাদর, ঘর-দুয়ার, ব্যবসা-বাণিজ্য, চা-কফি,আদর-অভ্যর্থনা, মানইজ্জত, আদবকায়দা, হাসিঠাট্টা |
৮. দুটি বিশেষ্যযোগে: | রাজা-রানী, ভাই-বোন, মা-বাবা, চোখ-কান, জন্ম-মৃত্যু, নদ-নদী, জীবন-মরণ, ধান-পাট |
৯. দুটি বিশেষণযোগে: | ভালো-মন্দ, কম-বেশি, আসল-নকল, বাকি-বকেয়া, ছোট-বড়, সৎ-অসৎ, সহজ-সরল, সত্য-মিথ্যা, উঁচু-নিচু |
১০. দুটি সর্বনামযোগে: | যা-তা, যে-সে, যার-তার, যথা-তথা, তুমি-আমি, যেখানে-সেখানে, যখন-তখন, যেমন-তেমন |
১১. দুটি ক্রিয়াযোগে: | আসা-যাওয়া, বলা-কওয়া, বাঁচা-মরা, ভাঙা-গড়া, দেখা-শোনা, লেখা-পড়া, দেওয়া-নেওয়া, চলা-ফেরা |
১২. দুটি ক্রিয়াবিশেষণযোগে: | ধীরে-সুস্থে, আগে-পিছে, আকারে-ইঙ্গিতে, পাকে-প্রকারে |
দ্বন্দ্ব সমাসের কতিপয় নিয়ম
- উভয় পদের অর্থ প্রাধান্য পায়: কোনো পদই অন্যটির অর্থকে ছোট করে না।
- সংযোগকারী অব্যয় ব্যবহৃত হয়: যেমন– “ও”, “এবং”, “আর”। উদাহরণস্বরূপ: মা ও বাবা = মা-বাবা।
- সমজাতীয় পদ (Parts of speech) ব্যবহৃত হয়: সমজাতীয় পদ = বিশেষ্য-বিশেষ্য, বিশেষণ-বিশেষণ, সর্বনাম-সর্বনাম বা ক্রিয়া-ক্রিয়া। উদাহরন:
- বিশেষ্য-বিশেষ্য: ভাই(বিশেষ্য) + ও + বোন(বিশেষ্য) = ভাই-বোন
- বিশেষণ-বিশেষণ: ভালো(বিশেষণ) + ও + মন্দ(বিশেষণ) = ভালো-মন্দ
- সর্বনাম-সর্বনাম: যা(সর্বনাম) + ও + তা(সর্বনাম) = যা-তা
- ক্রিয়া-ক্রিয়া: হেসে(ক্রিয়া) + ও + খেলে(ক্রিয়া) = হেসে-খেলে
- শ্রদ্ধেয়, স্ত্রীবাচক ও গৌরববোধক শব্দ আগে বসে:
- মা ও বাপ = মা-বাপ (স্ত্রীবাচক শব্দ "মা" আগে বসেছে)
- গুরু ও শিষ্য = গুরু-শিষ্য (শ্রদ্ধেয় শব্দ "গুরু" আগে বসেছে)
- রাজা ও প্রজা = রাজা-প্রজা ("রাজা" শব্দটি গৌরববোধক তাই আগে বসেছে)
- দেব ও দ্বিজ = দেব-দ্বিজ
- ছোট শব্দটি আগে বসে:
- দেনা ও পাওনা = দেনা-পাওনা
- পান ও তামাক = পান-তামাক
- জমা ও খরচ = জমা-খরচ
- মুড়ি ও মুড়কি = মুড়ি-মুড়কি
- লাভ ও লোকসান = লাভ-লোকসান
- হসন্ত, আ-কারান্ত ও সন্ধিযুক্ত শব্দ আগে বসে:
- সুখ্ ও দুঃখ = সুখ-দুঃখ
- নদ্ ও নদী = নদ-নদী
- দাস্ ও দাসী = দাস-দাসী
- খাল্ ও বিল = খাল-বিল
- সমান স্বরবিশিষ্ট শব্দের ক্ষেত্রে উ-কার বা ও-কার যুক্ত শব্দ পরে বসে:
- হাতি ও ঘোড়া = হাতি-ঘোড়া ("ঘোড়া" শব্দে ও-কার আছে, তাই পরে বসেছে)
- নাক ও মুখ = নাক-মুখ ("মুখ" শব্দে উ-কার আছে, তাই পরে বসেছে)
- কানা ও ঘুষা = কানা-ঘুষা ("ঘুষা" শব্দে উ-কার আছে, তাই পরে বসেছে)
কর্মধারয় সমাস
কর্মধারয় সমাসের শ্রেণীবিভাগ
১. সাধারণ কর্মধারয় সমাস
যে যা সে যিনি তিনি, সাধারণ কর্মধারয়ের কাছে সবাই ঋণী। |
বিশেষণে-বিশেষণে, বিশেষণে-বিশেষ্যে এবং বিশেষ্যে-বিশেষ্যে যে কর্মধারয় সমাস হয়, তাকে সাধারণ কর্মধারয় সমাস বলে। যেমন—
বিশেষণে-বিশেষ্যে কর্মধারয়
- নীল যে উৎপল = নীলোৎপল
- মহতী যে অষ্টমী = মহাষ্টমী
- ছিন্ন যে বস্তু = ছিন্নবস্তু
- নব যে অন্ন = নবান্ন
- মহান যে জন = মহাজন
- নীল যে দল = নীলদল
- সু যে পুরুষ = সুপুরুষ
- শুভ যে বিবাহ = শুভবিবাহ
- লাল যে পাথর = লালপাথর
- খাস যে মহল = খাসমহল
- রক্ত যে চন্দন= রক্তচন্দন
এরূপ: কালোপেঁচা[৫], লালফুল[৬], ফুলবাবু[৭], পূর্ণচন্দ্র[৮], নয়াদিল্লী[৯], কাঁচকলা[১০], শ্বেতপাথর[১১], রুদ্রবীণা[১২], প্রধানশিক্ষক/হেডমাস্টার[১৩], গুণীজন[১৪], ছিন্নপত্র[১৫], ঝরাপাতা[১৬], টকদই[১৭] ইত্যাদি।
বিশেষ্য আগে বসে এরূপ উদাহরণ:
- বাটা যে হলুদ = হলুদবাটা
- বীর যে শিশু = শিশুবীর
- উত্তম যে নর = নরোত্তম
- পোড়া যে বেগুন = বেগুনপোড়া
- পোড়া যে তেল = তেলপোড়া
- পোড়া যে কচু = কচুপোড়া
- ভাজা যে চাল = চালভাজা
- ভাজা যে মাছ = মাছভাজা
বিশেষণে-বিশেষণে কর্মধারয়
- যে চালাক সেই চতুর = চালাকচতুর
- যিনি শান্ত তিনিই শিষ্ট = শান্তশিষ্ট
- যে কানা সেই খোঁড়া = কানাখোঁড়া
- যিনি গণ্য তিনিই মান্য = গণ্যমান্য
- যা শীত তাই উষ্ণ = শীতোষ্ণ
- যা মৃদু তাই মন্দ = মৃদুমন্দ
- কাঁচা অথচ মিঠা/যা কাঁচা তাই মিঠা = কাঁচামিঠা
- যে হৃষ্ট সেই পুষ্ট = হৃষ্টপুষ্ট
- যা স্নিগ্ধ তাই উজ্জ্বল = স্নিগ্ধোজ্জ্বল
- খানিক মিঠে খানিক কড়া = মিঠেকড়া
- যা সহজ তাই সরল = সহজসরল
এরূপ : সাদাসিধে[১৮], বাঁধাধরা[১৯], দীনহীন[২০] ইত্যাদি।
বিশেষ্যে-বিশেষ্যে কর্মধারয়
- যিনি রাজা তিনিই বাদশাহ = রাজাবাদশাহ
- যিনি ডাক্তার তিনিই সাহেব = ডাক্তারসাহেব
- যিনি জজ তিনিই সাহেব = জজসাহেব
- যিনি শিক্ষক তিনিই মহাশয় = শিক্ষকমহাশয়
- যা বাংলা তাই দেশ = বাংলাদেশ
- যা পল্লী তা-ই গ্রাম = পল্লীগ্রাম
- যা গোলাপ তা-ই ফুল = গোলাপফুল
- যিনি গুরু তিনিই দেব = গুরুদেব
- যিনি রাজা তিনিই ঋষি = রাজর্ষি
এরূপ : গিন্নিমা[২১], বধূমাতা[২২], লাটসাহেব[২৩], খোকাবাবু[২৪], দাদাবাবু[২৫], দাদাঠাকুর[২৬], রাজসন্ন্যাসী[২৭] ইত্যাদি।
২. মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস
মাঝের পদসমূহ লোপ পাবে এবং ব্যাসবাক্যে "যে/যা/যার/যাতে" প্রভৃতি শব্দগুলি থাকবে না। |
যে কর্মধারয় সমাসে ব্যাসবাক্যের মধ্য পদ লোপ পায়, তাকে মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস বলে। যেমন—
- সিংহ চিহ্নিত আসন = সিংহাসন
- সাহিত্য বিষয়ক সভা = সাহিত্যসভা
- স্মৃতি রক্ষার্থে সৌধ = স্মৃতিসৌধ,
- ব্রাহ্মণ ধর্মীয় প্রধান পুরোহিত = ব্রাহ্মণপুরোহিত
- সূর্য উদয়কালীন মন্ত্র = সূর্যমন্ত্র
- গাছকদম = গাছে ফুটিত কদম
- সন্ধিগীত = সন্ধি যোগঘটানো গীত
- চিকিৎসাশাস্ত্র = চিকিৎসা বিষয়ক শাস্ত্র
- হাসি মাখা মুখ = হাসিমুখ
- বৌ পরিবেশন করা ভাত = বৌভাত
- মৌ সংগ্রহকারী/আশ্রিত মাছি = মৌমাছি
- মৌ ভর্তি চাক = মৌচাক
- গাড়ি রাখার জন্য বারান্দা = গাড়িবারান্দা
- মোম নির্মিত বাতি = মোমবাতি
- পল(মাংস) মিশ্রিত অন্ন = পলান্ন
- সাম্য বিষয়ক বাদ = সাম্যবাদ
- ভাই কল্যাণে ফোঁটা = ভাইফোঁটা
- রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি = রাষ্ট্রনীতি
- জল রাখার পাত্র = জলপাত্র
- ঘি মাখা ভাত = ঘিভাত
- ঘরে আশ্রিত জামাই = ঘরজামাই
- প্রীতি উপলক্ষে ভোজ = প্রীতিভোজ
- এক অধিক দশ = একাদশ
- ভিক্ষা লব্ধ অন্ন = ভিক্ষান্ন
- হাতে চালানো পাখা = হাতপাখা
- বাষ্প চালিত যান = বাষ্পযান
- সংবাদ বহনকারী পত্র = সংবাদপত্র
- শহীদ স্মরণে পালনীয় দিবস = শহীদ দিবস
- প্রীতিসূচক উপহার = প্রীতি উপহার
- বর অনুগমনকারী যাত্রী = বরযাত্রী
- স্বর্ণের ন্যায় উজ্জ্বল অক্ষর = স্বর্ণাক্ষর
- ছায়া প্রধান তরু = ছায়াতরু
- আয়ের উপর ধার্য কর = আয়কর
- মাতার মৃত্যু জনিত দায় = মাতৃদায়
- জীবনহানির আশঙ্কায় বীমা = জীবনবীমা
- আক্ষেপ-দ্যোতক অনুরাগ = আক্ষেপানুরাগ
- ছাত্র থাকাকালীন জীবন = ছাত্রজীবন
- সিঁদুর রাখিবার কৌটা = সিঁদুরকৌটা
এরূপ : বিজয়পতাকা[২৮], জয়ধ্বনি[২৯], জীবন্মৃত[৩০], কাঁচকলা[৩১], নাতজামাই, ডাকগাড়ি, ডাকবাক্স[৩২], নারীদিবস, হাঁটুজল[৩৩], সিংহদ্বার, হাতঘড়ি, চালকুমড়া, বনফুল, জয়মুকুট[৩৪], সন্ধ্যাপ্রদীপ[৩৫], টিপসই, ধর্মঘট[৩৬], গীতিকবিতা[৩৭], জগদীশ্বর, শাখামৃগ, বৌদ্ধধর্ম, অষ্টাদশ, মমতারস[৩৮], মধ্যাহ্নভোজন, পল্লীসাহিত্য, গঙ্গানদী, পানাপুকুর[৩৯] ইত্যাদি।
৩. উপমান কর্মধারয় সমাস
Noun + Adjective |
উপমান = কমন বৈশিষ্ট্য থাকবে |
উপমান পদের সাথে সাধারণ ধর্ম বা গুণবাচক পদের যে সমাস হয়, তাকে উপমান কর্মধারয় সমাস বলে। এতে গুণের উল্লেখ থাকে বলে, প্রথমটি বিশেষ্য পদ এবং পরের পদটি বিশেষণ পদ হয়। উপমান পদটি পূর্বপদ হয়। যেমন—
উপমান কর্মধারয় সমাস | কমন বৈশিষ্ট্য |
---|---|
তুষারের ন্যায় শুভ্র = তুষারশুভ্র | উভয়ই সাদা |
কুসুমের মতো কোমল = কুসুমকোমল | উভয়ই কোমল |
স্বর্ণের মতো উজ্জ্বল = স্বর্ণোজ্জ্বল | উভয়ই উজ্জ্বল |
বজ্রের ন্যায় কঠোর/কঠিন = বজ্রকঠোর/বজ্রকঠিন | উভয়ই কঠোর/কঠিন |
কাজলের মতো কালো = কাজলকালো | উভয়ই কালো |
অরুণের মতো রাঙা = অরুণরাঙা | উভয়ই রঙিন |
মিশির ন্যায় কালো = মিশকালো | উভয়ই কালো |
ইস্পাতের ন্যায় কঠিন = ইস্পাতকঠিন | উভয়ই কঠিন |
শশকের (খরগোশ) ন্যায় ব্যস্ত = শশব্যস্ত | উভয়ই ব্যস্ত |
গরুর ন্যায় বেচারা = গোবেচারা | উভয়ই বেচারা |
এরূপ : ভ্রমরকৃষ্ণ, ভ্রমরকৃষ্ণকেশ, বরফশীতল, তুষারধবল, শঙ্খধবল, বিড়ালতপস্বী, বকধার্মিক, সিঁদুররাঙা, আলতারাঙা, চন্দনস্নিগ্ধ, গজমূর্খ/হস্তীমূর্খ, রক্তলাল, নিমতিতা, ধনুকবাঁকা, হরিণচপল, ঘনশ্যাম, জলদগম্ভীর, চিঁড়েচ্যাপটা, শালপ্রাংশু, পল্লবপেলব ইত্যাদি।
৪. উপমিত কর্মধারয় সমাস
Noun + Noun |
উপমিত = মিথ্যা তুলনা দেয়া হয় |
সাধারণ গুণের উল্লেখ না করে উপমেয় পদের সাথে উপমান পদের যে সমাস হয়, তাকে উপমিত কর্মধারয় সমাস বলে। এক্ষেত্রে সাধারণ গুণটি উহ্য থাকে। এ সমাসে উপমেয় পদটি পূর্বপদ হয়। যেমন—
- মুখ চন্দ্রের ন্যায় = মুখচন্দ্ৰ
- কথা অমৃতের ন্যায় = কথামৃত
- চরণ কমলের/পদ্মের ন্যায় = চরণকমল/চরণ পদ্ম
- পুরুষ সিংহের ন্যায় = সিংহপুরুষ
- অধর কমলের ন্যায় = অধরকমল
- কর পল্লবের ন্যায় = করপল্লব
- কপি ফুলের ন্যায় = ফুলকপি
- সন্দেশ আমের ন্যায় = আমসন্দেশ
এরূপ : বাহুলতা[৪০], চন্দ্রবদন[৪১], নরসিংহ[৪২], পদপল্লব[৪৩], অধরপল্লব[৪৪], চাঁদমুখ[৪৫], সোনামুখ[৪৬], পদ্মলোচন/পদ্মআঁখি[৪৭], ফুলকুমারী[৪৮], কথামৃত[৪৯], বাহুবল্লরী[৫০], পদলোহা[৫১], নয়নকমল[৫২], মনবিহঙ্গ[৫৩] ইত্যাদি।
"উপমান মানে Noun+Adjective । যেমন, তুষারশুভ্র শব্দটির তুষার মানে বরফ যা Noun, আর শুভ্র মানে সাদা এবং তা Adjective । কাজলকালো শব্দটির কাজল হলো Noun, এবং কালো হলো Adjective । অতএব Noun+Adjective — উপমান কর্মধারয় সমাস। একইভাবে উপমিত মানে Noun+Noun । যেমন, পুরুষসিংহ শব্দটির পুরুষ ও সিংহ দুটোই Noun । অর্থাৎ Noun+Noun । একইভাবে চন্দ্রমুখ শব্দটির চন্দ্র ও মুখ দুটিই Noun । অর্থাৎ Noun+Noun । অতএব Noun+Noun — উপমিত কর্মধারয় সমাস"
৫. রূপক কর্মধারয় সমাস
উপমান ও উপমেয় পদের মধ্যে অভিন্নতা কল্পনা করে যে সমাস হয়, তাকে রূপক কর্মধারয় সমাস বলে। এ সমাসে উপমেয় পদ আগে বসে এবং উপমান পদ পরে বসে। এছাড়া সমস্যমান পদে ‘রূপ’ শব্দটি যুক্ত হয়ে ব্যাসবাক্য গঠিত হয়। যেমন—
- স্নেহ রূপ সুধা = স্নেহসুধা
- ভব রূপ নদী = ভবনদী
- বিষাদ রূপ সিন্ধু = বিষাদসিন্ধু
- মন রূপ মাঝি = মনমাঝি
- হৃদয় রূপ আকাশ = হৃদয়াকাশ
- শোক রূপ অনল = শোকানল
- ক্রোধ রূপ অনল = ক্রোধানল
- দিল রূপ দরিয়া = দিলদরিয়া
- প্রাণ রূপ পাখি = প্রাণপাখি
- জীবন রূপ প্রদীপ = জীবনপ্রদীপ
এরূপ : জীবনতরী, জীবনস্রোত, জীবনযুদ্ধ, জ্ঞানবৃক্ষ, প্রাণবায়ু, প্রাণপ্রবাহিণী, দেহমাতৃকা, যৌবনসূর্য, যৌবনকুসুম, হৃদয়কুসুম, হৃদয়ারণ্য, হৃদয়াকাশ, অলসতন্দ্রা, মায়াডোর, প্রেমডোর, ভবসাগর/সংসারসাগর, ভবসিন্ধু, বিদ্যাধন, দেহপিঞ্জর, স্নেহনীড়, স্নেহসমুদ্র, ভক্তিসুধা, শোকসিন্ধু, ক্ষুধানল, রোষানল, সমরানল ইত্যাদি।
কর্মধারয় সমাসের কতিপয় নিয়ম
- কর্মধারয় সমাসের ব্যাসবাক্যে সাধারণত— যিনি-তিনি, যে-সে, যা-তা, যেই-সেই ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়।
- কর্মধারয় সমাসে সাধারণত বিশেষণ পদ আগে বসে:
- সুন্দর যে পুরুষ = সুপুরুষ
- রক্ত যে কমল = রক্তকমল
- নীল যে অক্ষি = নীলাক্ষি
- নীল যে মণি = নীলমণি
- নীল যে আকাশ = নীলাকাশ
- ভরা যে যৌবন = ভরাযৌবন
- নব যে যৌবন = নবযৌবন
- দুটি বিশেষণ পদে একটি বিশেষ্য বোঝালে কর্মধারয় সমাস হয়:
- যা মৃদু তাই মন্দ = মৃদুমন্দ
- যে চালাক সেই চতুর = চালাকচতুর
- যে শান্ত সেই শিষ্ট= শান্তশিষ্ট
- সে হৃষ্ট সেই পুষ্ট = হৃষ্টপুষ্ট
- যা মিষ্টি তাই মধুর = মিষ্টিমধুর
- যা সহজ, তাই সরল = সহজসরল
- দুটি বিশেষ্য পদে একই ব্যক্তি বা বস্তুকে বোঝালে কর্মধারয় সমাস হয়:
- যিনি রাজা তিনি ঋষি = রাজর্ষি
- যিনি দেব তিনি ঋষি = দেবর্ষি
- যিনি জজ তিনি সাহেব = জজসাহেব
- যিনি মৌলভী তিনি সাহেব = মৌলভীসাহেব
- যিনি নর তিনি দেবতা = নরদেবতা
- যিনি দীন তিনিই দরিদ্র = দীনদরিদ্র
- কর্মধারয় সমাসে বিশেষণ পদের পুংলিঙ্গ রূপ হয়:
- মহতী যে কীর্তি = মহাকীর্তি
- মহতী যে রাণী = মহারাণী
- সুন্দরী যে লতা = সুন্দরলতা
- মহতী যে নদী = মহানদী
- পূর্বপদে 'মহৎ' কিংবা 'মহান' থাকলে এর পরিবর্তে 'মহা' শব্দটি ব্যবহৃত হয়:
- মহৎ যে জ্ঞান = মহাজ্ঞান
- মহৎ যে জন = মহাজন
- মহৎ যে আশয় = মহাশয়
- মহৎ যে অরণ্য = মহারণ্য
- মহান যে নবী = মহানবী
- মহান যে বীর = মহাবীর
- পরপদে 'রাজা' শব্দ থাকলে 'রাজ' হয় এবং 'রাত্রি' শব্দ থাকলে 'রাত্র' হয়:
- মহান যে রাজা = মহারাজ
- দীর্ঘ যে রাত্রি = দীর্ঘরাত্র
- পূর্বপদে সুন্দর স্থানে 'সু' এবং কুৎসিত স্থানে 'কু' বা 'কদ' হয়:
- সুন্দর যে নিয়ম = সুনিয়ম
- কুৎসিত যে কথা = কুকথা
- কু যে আচার = কদাচার
- কু যে অর্থ = কদৰ্থ
- কু যে আকার = কদাকার
- বিশেষণ ও বিশেষ্য পদে কর্মধারয় সমাস হলে কখনো কখনো বিশেষণ পরে আসে, বিশেষ্য আগে যায়:
- সিদ্ধ যে আলু= আলুসিদ্ধ
- অধম যে নর= নরাধম
- কার্যে পরম্পরা বোঝাতে দুইটি কৃদন্ত বিশেষণ পদেও কর্মধারয় সমাস হয়:
- আগে ধোয়া পরে মোছা= ধোয়ামোছা
তৎপুরুষ সমাস
বিভক্তি লোপ পাবে। | ||
তৎপুরুষ সমাস | বিভক্তি | বিশেষ শব্দাবলী |
---|---|---|
২য়া তৎপুরুষ | কে, রে (সাধারণ অর্থে), ব্যাপিয়া | চির, অতীত, আপন্ন, গত, প্রাপ্ত, প্রবিষ্ট, সংক্রান্ত, আশ্রিত, আরূঢ় |
৩য়া তৎপুরুষ | দ্বারা, দিয়া, কর্তৃক (by) | ঊন, হীন, শূন্য, কম |
৪র্থী তৎপুরুষ | কে/রে (নিঃস্বার্থে প্রদান/প্রদর্শন), জন্য, নিমিত্ত, উদ্দেশ্য (for) |
— |
৫মী তৎপুরুষ | হতে, থেকে, চেয়ে, অপেক্ষা (from/than) | চ্যুত, বিচ্যুত, ভীত, ভ্রষ্ট, মুক্ত (খালাস), আগত (ফেরত), গৃহীত, উত্তীর্ণ, পালানো |
৬ষ্ঠী তৎপুরুষ | র, এর (of) | সহ, সম, তুল্য, প্রায়, গণ, নিভ, গ্রাম, প্রতিম, যূথ, বৃন্দ, পুঞ্জ, রাজি |
৭মী তৎপুরুষ | এ, তে, এতে (at) | — |
উপপদ তৎপুরুষ | বিশেষ্য + ক্রিয়া + যে/যা/যার | — |
নঞ তৎপুরুষ | ন/না/নাই (not) | — |
অলুক তৎপুরুষ | বিভক্তি থাকবে, কিন্তু লোপ পাবে না | — |
তৎপুরুষ কথাটির সাধারণ অর্থ ‘তার পুরুষ’। যে সমাসের ব্যাসবাক্যে সমস্যমান পদদুটির মধ্যে পরপদটি প্রধান হয় এবং পূর্বপদের কারকবোধক ও সম্বন্ধবোধক বিভক্তি বা অনুসর্গ লোপ পায়, তাকে তৎপুরুষ সমাস বলা হয়। যেমন – রান্নাঘর রান্নার জন্য ঘর। এই ব্যাসবাক্যে ‘রান্না’ ও ‘ঘর’-এর মধ্যে ‘ঘর’-এর প্রাধান্য আছে। ব্যাসবাক্যে ‘জন্য’ বিভক্তিটি সমাসনিষ্পন্ন পদে লোপ পেয়েছে।
তৎপুরুষ সমাসের শ্রেণীবিভাগ
১. দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস
পূর্বপদে দ্বিতীয়া বিভক্তি লোপ পেয়ে যে সমাস হয়, তাকে দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস বলে। প্রাপ্ত, আশ্রিত, সংক্রান্ত, গত, অতীত, আপন্ন, প্রবিষ্ট, আরূঢ় প্রভৃতি শব্দযোগে দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস হয়। আবার, 'ব্যাপ্তি' বোঝাতে কালবাচক পদের সাথে দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস হয়ে থাকে। যেমন–
- রথকে দেখা = রথদেখা
- বীজকে বোনা = বীজবোনা,
- লুচিকে ভাজা = লুচিভাজা
- ছেলেকে ভোলানো = ছেলে ভোলানো
- গাকে ঢাকা = গা-ঢাকা
- লোককে দেখানো = লোক দেখানো
(বিশেষ শব্দাবলী দ্বারা গঠিত:)
- দুঃখকে প্রাপ্ত = দুঃখপ্রাপ্ত
- ক্ষমতাকে প্রাপ্ত = ক্ষমতাপ্রাপ্ত
- বয়ঃ (বয়স)-কে প্রাপ্ত = বয়ঃপ্রাপ্ত
- চরণকে আশ্রিত = চরণাশ্রিত
- পদকে আশ্রিত = পদাশ্রিত
- দেশকে আশ্রিত = দেশাশ্রিত
- ব্যক্তিকে গত = ব্যক্তিগত
- পরলোকে গত = পরলোকগত
- পুঁথিতে গত= পুঁথিগত
- শরণকে আগত = শরণাগত
- স্মরণকে অতীত = স্মরণাতীত
- ধর্মকে অতীত = ধর্মাতীত
- বিস্ময়কে আপন্ন = বিস্ময়াপন্ন
- বিপদকে আপন্ন = বিপদাপন্ন
- গৃহকে প্রবিষ্ট = গৃহপ্রবিষ্ট
- অশ্বকে আরূঢ় = অশ্বারূঢ়
('ব্যাপ্তি' অর্থে:)
- চিরকাল ব্যাপিয়া বসন্ত = চিরবসন্ত
- চিরকাল ব্যাপিয়া সুন্দর = চিরসুন্দর
- চিরকাল ব্যাপিয়া সুখী = চিরসুখী
- দীর্ঘকাল ব্যাপিয়া স্থায়ী = দীর্ঘস্থায়ী
- ক্ষণকাল ব্যাপিয়া স্থায়ী = ক্ষণস্থায়ী
- চিরকাল ব্যাপিয়া বঞ্চিত = চিরবঞ্চিত
- জীবন ব্যাপিয়া আনন্দ = জীবনানন্দ
- বিশ্ব ব্যাপী যুদ্ধ = বিশ্বযুদ্ধ
এরূপ : বইপড়া, নভেল-পড়া, দেশোদ্ধার, ভাতরাঁধা, বাসনধোয়া, কলাবেচা, ঘাসকাটা, গুণটানা, মাথাগোঁজা, ফুলতোলা, কাপড়কাঁচা, চিরশত্রু, চিরকৃতজ্ঞ, চিরহরিৎ, চিরচঞ্চল, চিরস্মরণীয়, লোকঠকানো, সাপখেলানো, বধূবরণ, নবীনবরণ ইত্যাদি।
২. তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাস
পূর্বপদে তৃতীয়া বিভক্তি লোপ পেয়ে যে সমাস হয়, তাকে তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন–
- শোক দ্বারা আকুল = শোকাকুল
- অস্ত্র দ্বারা উপচার = অস্ত্রোপচার
- শ্রী দ্বারা যুক্ত = শ্রীযুক্ত
- লাঠি দ্বারা খেলা = লাঠিখেলা
- বজ্র দ্বারা আহত = বজ্রাহত
- মন দিয়ে গড়া = মনগড়া
- ঢেঁকি দিয়ে ছাঁটা = ঢেঁকিছাঁটা
- মধু দিয়ে মাখা = মধুমাখা
- কুসুম ধারা আস্তীর্ণ = কুসুমাস্তীর্ণ
- রত্ন দ্বারা শোভিত = রত্নশোভিত
- ট্রেন দ্বারা ভ্রমণ = ট্রেনভ্রমণ
- বাক দ্বারা দত্তা = বাগদত্তা
(বিশেষ শব্দাবলী দ্বারা গঠিত:)
- এক দ্বারা ঊন = একোন
- বিদ্যা দ্বারা হীন = বিদ্যাহীন
- শ্রী দ্বারা হীন = শ্রীহীন
- পিতৃ দ্বারা হীন = পিতৃহীন
- বুদ্ধি দ্বারা রহিত = বুদ্ধিরহিত
- জ্ঞান দ্বারা শূন্য = জ্ঞানশূন্য
- পাঁচ দ্বারা কম = পাঁচকম
এরূপ : স্বর্ণমণ্ডিত, হিরককখচিত, চন্দনচর্চিত, কণ্টকাকীর্ণ, জুতো-পেটা, ঘিভাজা, শান-বাঁধানো, পদাঘাত, মোহান্ধ, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, স্নেহাস্প, স্বনামধন্য, রসসিক্ত, শ্রমলব্ধ, বিপদসঙ্কুল, মেঘাচ্ছন্ন, বায়ুপূর্ণ ইত্যাদি।
৩. চতুর্থী তৎপুরুষ সমাস
পূর্বপদে চতুর্থী বিভক্তি লোপ পেয়ে যে সমাস হয়, তাকে চতুর্থী তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন–
- গুরুকে ভক্তি = গুরুভক্তি
- দেবকে দত্ত = দেবদত্ত
- বসতের নিমিত্ত বাড়ি = বসতবাড়ি
- শয়নের নিমিত্ত কক্ষ = শয়নকক্ষ
- হজ্বের উদ্দেশ্যে যাত্রা = হজ্বযাত্রা
- আরামের জন্য কেদারা = আরামকেদারা
- বিয়ের জন্য পাগলা = বিয়েপাগলা
- ডাকের নিমিত্ত মাশুল = ডাকমাশুল
- জীয়নের নিমিত্ত কাঠি = জীয়নকাঠি
এরূপ : মুক্তিযুদ্ধ, ছাত্রাবাস, দূতাবাস, পান্থনিবাস, এতিমখানা, মুসাফিরখানা, মালগুদাম, পাঠকক্ষ, রান্নাঘর, শান্তিনিকেতন, স্মৃতিমন্দির, পাগলাগারদ, শিশুমঙ্গল, শিশুসাহিত্য, পুত্রশোক, মরাকান্না, তপোবন, চোষকাগজ, মাপকাঠি, সংবাদপত্র, খাদ্যআন্দোলন, লোকহিত, বালিকাবিদ্যালয় ইত্যাদি।
৪. পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাস
পূর্বপদে পঞ্চমী বিভক্তি (হতে, থেকে, চেয়ে, অপেক্ষা ইত্যাদি) লোপ পেয়ে যে সমাস হয়, তাকে পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন–
- গণ হতে মুক্তি = গণমুক্তি
- বিলাত হতে ফেরত = বিলাতফেরত
- স্কুল থেকে পালানো = স্কুলপালানো
- সত্য থেকে ভ্রষ্ট = সত্যভ্রষ্ট
- জন্ম হতে অন্ধ = জন্মান্ধ
- জেল থেকে খালাস/মুক্ত = জেলখালাস/জেলমুক্ত
- প্রাণের/পরাণের চেয়ে প্রিয় = প্রাণপ্রিয়/পরাণপ্রিয়
- মানব অপেক্ষা ইতর = মানবেতর
এরূপ : বোঁটাখসা, আগাগোড়া, ঘরপালানো, রোগমুক্তি, শাপমুক্তি, ব্যাধিমুক্ত, ঋণমুক্ত, মেঘমুক্ত, যুদ্ধোত্তর, স্নাতকোত্তর, খাঁচাছাড়া, দলছাড়া, গ্রামছাড়া, পদচ্যুত, ক্ষমতাচ্যুত, রাজ্যচ্যুত, দুগ্ধজাত, প্রাণাধিক, জলাতঙ্ক ইত্যাদি।
৫. ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস
পূর্বপদের ষষ্ঠী বিভক্তি (র, এর) লোপ পেয়ে যে সমাস হয়, তাকে ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন–
- খেয়ার ঘাট = খেয়াঘাট
- নদীর জল = নদীজল
- চায়ের বাগান = চা-বাগান
- মনের রথ = মনোরথ
- বসন্তের সখা = বসন্তসখ (কোকিল)
- মন্ত্রীদের সভা = মন্ত্রীসভা
- বৃক্ষের শাখা = বৃক্ষশাখা
- দীনের বন্ধু = দীনবন্ধু
- কবিদের গুরু = কবিগুরু
- নরের অধম = নরাধম
- ছাত্রের সমাজ = ছাত্রসমাজ
- ভোটের অধিকার = ভোটাধিকার
- রাজার প্রাসাদ = রাজপ্রাসাদ
- পুত্রের বধূ = পুত্রবধূ
- স্ব-এর অধীন = স্বাধীন
এরূপ : জাতিসংঘ, রাষ্ট্রপতি, রাজমাতা, ঘোড়দৌড়, বিড়ালছানা, নাট্যাভিনয়, যমালয়, শশুরবাড়ি, সূর্যালোক, কর্মফল, বনফুল, বাঁদরনাচ, ছবিঘর, রান্নাঘর, বটতলা, মাঝপথ, দেশসেবা, পিতৃতুল্য, ধানক্ষেত, পাটক্ষেত, গৃহশিশু, সাহিত্যবিশারদ, নদীতীর, সমুদ্রতট, দানসামগ্রী ইত্যাদি।
ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাসের সাধারণ নিয়ম
- ব্যাসবাক্যে ‘রাজা’ শব্দটি সাধারণত পরে বসে, তবে ‘রাজা’-এর স্থলে সর্বদা ‘রাজ' হয়:
- পথের রাজা = রাজপথ
- রোগের রাজা = রাজরোগ
- হাঁসের/হংসের রাজা = রাজহাঁস/রাজহংস
- রাজার পুত্র/কুমার = রাজপুত্র/রাজকুমার
- গজনীর রাজা = গজনীরাজ
- দিল্লীর রাজা = দিল্লীরাজ
- ‘অর্ধ’ শব্দ পরে থাকলে আগে বসে:
- টাকার অর্ধ = অর্ধটাকা
- পথের অর্ধ = অর্ধপথ
- দিনের অর্ধ = অর্ধদিন
- পূর্বপদের ঈ-কার যুক্ত শব্দে ই-কার যুক্ত হয়:
- প্রাণীর বিদ্যা/বিজ্ঞান = প্রাণিবিদ্যা/প্রাণিবিজ্ঞান
- স্বামীর গৃহ = স্বামিগৃহ
- পিতা, মাতা, ভ্রাতা শব্দের পরিবর্তে পিতৃ, মাতৃ, ভ্রাতৃ ব্যবহার:
- মাতার সোহাগ = মাতৃসোহাগ
- মাতার সেবা = মাতৃসেবা
- মাতার হৃদয় = মাতৃহৃদয়
- পিতার ধন = পিতৃধন
- ভ্রাতার স্নেহ = ভ্রাতৃস্নেহ
- পরপদে সহ, তুল্য, প্রায়, সম, নিভ, প্রতিম ইত্যাদি শব্দ থাকলে পূর্বপদে এর লোপ পায়:
- পিতার তুল্য = পিতৃতুল্য
- গুরুর তুল্য = গুরুতুল্য
- অনুজের প্রতিম = অনুজপ্রতিম
- সহোদরের প্রতিম = সহোদরপ্রতিম/সোদরপ্রতিম
- পত্নীর সহ = পত্নীসহ
- কন্যার সহ = কন্যাসহ
- পিতার সম = পিতৃসম
- কালের কোন অংশবোধক শব্দ পরে থাকলে তা আগে বসে:
- অহ্নের (দিনের) পূর্বভাগ = পূর্বাহ্ণ
- রাত্রির মধ্যভাগ = মধ্যরাত্র
- গণ, বৃন্দ, রাজি, যূথ ইত্যাদি সমষ্টিবাচক শব্দ পরে থাকলে ষষ্ঠী তৎপুর সমাস হয়:
- ছাত্রের বৃন্দ = ছাত্রবৃন্দ
- শিক্ষকের বৃন্দ = শিক্ষকবৃন্দ
- ফুলের রাজি = ফুলরাজি
- তারকার/নক্ষত্রের রাজি = তারকারাজি/নক্ষত্ররাজি
- হস্তীর যূথ = হস্তীযূথ
- গুণের গ্রাম = গুণগ্রাম
- দুগ্ধ, শিশু, ডিম্ব, শাবক ইত্যাদি শব্দ পরে থাকলে স্ত্রীবাচক পূর্বপদটি পুরুষবাচক হয়:
- মৃগীর/হরিণীর শিশু = মৃগশিশু/হরিণশিশু
- ছাগীর দুগ্ধ = ছাগদুগ্ধ
- বাঘিনীর দুগ্ধ = ব্যাঘ্রদুগ্ধ
- হংসীর ডিম্ব = হংসডিম্ব
৬. সপ্তমী তৎপুরুষ সমাস
যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদের সপ্তমী বিভক্তি (এ, য়, তে) লোপ পায়, তাকে সপ্তমী তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন–
- বিশ্বে বিখ্যাত = বিশ্ববিখ্যাত
- পাপে আসক্ত = পাপাসক্ত
- নামাজে রত = নামাজরত
- মনে মরা = মনমরা
- অকালে মৃত্যু = অকালমৃত্যু
- গাছে পাকা = গাছপাকা
- গোলায় ভরা = গোলাভরা
- বাক্সতে বন্দী = বাক্সবন্দী
- গৃহে বন্দী = গৃহবন্দী
(সমস্ত পদটির পরপদে "পূর্ব" শব্দটি থাকলে ব্যাসবাক্যে তা আগে বসে:)
- পূর্বে ভূত = ভূতপূর্ব
- পূর্বে অশ্রুত = অশ্রুতপূর্ব
- পূর্বে অদৃষ্ট = অদৃষ্টপূর্ব
এরূপ : দিবানিদ্রা, মাথাব্যথা, জলমগ্ন, ধ্যানমগ্ন, পিঞ্জরাবদ্ধ, বস্তাপঁচা, বাক্সপঁচা, ভোজনপটু, বাকপটু, রাতকানা, তালকানা, গৃহবাস, বনভোজন, দানবীর, ধর্মবিশ্বাস ইত্যাদি।
৭. অলুক তৎপুরুষ সমাস
‘অলুক’ অর্থ লোপ না পাওয়া। যদি পূর্বপদের বিভক্তি লোপ না হয়, তাহলে তাকে অলুক তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন–
- সোনার তরী = সোনারতরী
- ঘিয়ে ভাজা = ঘিয়ে ভাজা
- পড়ার ঘর = পড়ার ঘর
- কলুর বলদ = কলুর বলদ
এরূপ : ঘোড়ার ডিম, হাতের পাঁচ, সাপের পা, তেলেভাজা, চায়ের কাপ, পড়ার টেবিল, চোখের জল, কলে ছাঁটা, কলের পানি, কলের গান, খবরের কাগজ, ভোরের পাখি, মাটির মানুষ, মনের মানুষ, চোখের বালি, মামার বাড়ি, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, কলেজে পড়া, গায়ে পড়া, দিনে ডাকাতি, খেচর, পথে নামা, বানে ভাসা ইত্যাদি।
কিন্তু ভ্রাতার পুত্র = ভ্রাতুষ্পুত্র (নিপাতনে সিদ্ধ)।
৮. নঞ তৎপুরুষ সমাস
যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদে না-সূচক অব্যয় থাকে, তাকে নঞ তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন–
- না ধোয়া = আধোয়া
- নাই খোঁজ = নিখোঁজ
- নয় হাজির = গরহাজির
- নাই খরচা = নিখরচা
- নয় মঞ্জুর = নামঞ্জুর
- নয় আচার = অনাচার
- নাই হায়া যার = বেহায়া
- নয় অতি খর্ব = অখর্ব
- নয় অতি দীর্ঘ = নাতিদীর্ঘ
- ন কাতর = অকাতর
- ন মানান = বেমানান
- নাই বৃষ্টি = অনাবৃষ্টি
- নয় রাজি = নারাজ
এরূপ : অচেনা, অজানা, অচল, অমিল, অজ্ঞান, অনুর্বর, অনাদর, অনাসৃষ্টি, অবিশ্বাস, অনাবাদী, অনিচ্ছা, অনৈক্য, অবাধ্য, অসুখ, অদৃষ্ট, আকাল, গরমিল, গররাজি, নাতিবৃহৎ, নাতিশীতোষ্ণ, অনধিক, অনভিজ্ঞ, অনাহূত, নিখুঁত, নির্ভুল, নিরাশা, নিরামিষ, নিরুৎসাহিত, বিদেশ, বিসদৃশ, বিভুঁই, বেআইনি, বেহিসেব ইত্যাদি।
৯. উপপদ তৎপুরুষ সমাস
যেসব পদের পরবর্তী ধাতুর সাথে কৃৎ প্রত্যয় যুক্ত হয়, তাকে বলে উপপদ। আর উপপদের সাথে কৃদন্ত পদের যে সমাস হয়, তাকে বলে উপপদ তৎপুরুষ সমাস। যেমন—
- জলে জন্মে যা = জলজ
- মুখে থাকে যা = মুখস্থ
- জল দেয় যে = জলদ
- জলে চরে যে = জলচর
- পঙ্কে জন্মে যা = পঙ্কজ
- অগ্রে জন্মে যে = অগ্রজ
- মধু পান করে যে = মধুপ
- ছেলে ধরে যে = ছেলেধরা
- স্থলে চরে যে = স্থলচর
- জাদু করে যে = জাদুকর
- গণিত জানেন যিনি = গণিতজ্ঞ
- শাস্ত্র জানেন যিনি = শাস্ত্রজ্ঞ
- নেশা করে যে = নেশাকর
- ঘুষ খায় যে = ঘুষখোর
- অরিকে দমন করে যে = অরিন্দম
এরূপ : আত্মজ, উরগ, গোপ, মানুষখেকো, ভাতখেকো, কুম্ভকার, মধুকর, সূত্রধর, শাস্ত্রকার, ইন্দ্রজিৎ, মনোলোভা, পকেটমার, প্রজাপালক, বসুন্ধরা, ধামাধরা, দিশাহারা, বর্ণচোরা, কলাধর, পাতাচাটা, হাড়ভাঙ্গা, মাছিমারা, ঘরপোড়া, ঘরছাড়া, গলাকাটা, ছা-পোষা, গা-সহা, পা চাটা, সত্যবাদী, গৃহস্থ, ছারপোকা, পাড়াবেড়ানি ইত্যাদি।
বহুব্রীহি সমাস
"যার" এবং "যাতে" বহুব্রীহি হয় তাতে |
সমস্ত পদটি সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করবে |
যে সমাসে সমস্যমান পদগুলোর কোনটির অর্থ না বুঝিয়ে সমস্তপদে অন্য কোন ব্যক্তি, বস্তু বা পদার্থকে বোঝায়, তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন— দশ আনন (মুখ) যার = দশানন (দশটি মুখমন্ডল) এখানে পূর্বপদ ‘দশ’ এবং পরপদ ‘আনন’। সমস্তপদে ‘দশ’ কিংবা ‘আনন’ কোনটিরই অর্থ না বুঝিয়ে একটি ভিন্ন অর্থ বুঝিয়েছে। ‘দশানন' বলা হয় রাবণকে।
যে সমাসে পূর্বপদ ও পরপদ কোনটিরই অর্থ না বুঝিয়ে, তৃতীয় পদ তথা সমস্ত পদকে বুঝিয়ে থাকে,তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে। এখানে সবসময়ই তৃতীয় অর্থ প্রকাশ পাবে।
উদাহরণ: খোশ মেজাজ যার = খোশমেজাজ
এখানে,পূর্বপদ খোশ মানে খুশি, আবার মেজাজ মানে মানসিক অবস্থা। তবে, সমস্তপদে খুশিকেও বোঝায়নি আবার মেজাজকেও বোঝায়নি । অর্থাৎ, 'খোশমেজাজ'কে বুঝিয়েছে। মানে, ভালো মেজাজওয়ালা ব্যক্তিকে বুঝিয়েছে।
আশীতে বিষ যার = আশীবিষ
এখানে,পূর্বপদ আশী মানে সাপের বিষ দাঁত । আবার বিষ মানে ভীষন ক্ষতিকর তরল পদার্থ। কিন্তু, সমস্তপদে আশীবিষ মানে সাপ । অর্থাৎ সাপের বিষ দাঁতকেও বোঝায়নি, আবার বিষকেও বোঝায়নি, বুঝিয়েছে সাপকে।
হত হয়েছে শ্রী যার = হতশ্রী
এখানে, হত মানে চুরি আবার শ্রী মানে মুখমন্ডল বা সৌন্দর্য। অথচ, সমস্তপদে হতশ্রী মানে, যে খুব অসহায়,যার কিছু নেই। অর্থাৎ, হতকেও বোঝায়নি আবার মুখকেও বোঝায়নি, বুঝিয়েছে যার কিছু নেই।
Confusion Alert: অনেকেই ‘সেতার’ শব্দটিকে দ্বিগু সমাস মনে করে যেভাবে ব্যাসবাক্য করে তা হলো: সে(তিন) তারের সমাহার — সেতার। কিন্তু ‘সেতার’ বলতে শুধু তিনটি তারকে বুঝায়না; এটি একটি বিশেষ বাদ্যযন্ত্রকে বুঝায় যার তিনটি তার রয়েছে। অর্থাৎ এটি বহুব্রীহি সমাসের নিয়মানুযায়ী অন্য অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই এটিকে দ্বিগু সমাসে না করে সংখ্যাবাচক বহুবীহি সমাসের নিয়মে করতে হবে।
বহুব্রীহি সমাসের শ্রেণীবিভাগ
১. সাধারণ/সমানাধিকরণ বহুব্রীহি
Adjective—Noun |
যে বহুব্রীহি সমাসের পূর্বপদ বিশেষণ এবং পরপদ বিশেষ্য হয়, তাকে সমানাধিকরণ বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন–
- গৌর অঙ্গ যার = গৌরাঙ্গ
- কৃত অঞ্জলি যার = কৃতাঞ্জলি
- দৃঢ় প্রতিজ্ঞা যার = দৃঢ়প্রতিজ্ঞ
- নীল বসন যার = নীলবসনা
- খোশ মেজাজ যার = খোশমেজাজ
- স্বল্প আয়ু যার = স্বল্পায়ু
- পেট সর্বস্ব যার = পেটসর্বস্ব
- দিক অম্বর যার = দিগম্বর
- সু গন্ধ যার = সুগন্ধ
- মধ্য বিত্ত যার = মধ্যবিত্ত
- মূঢ় মতি যার = মূঢ়মতি
- বিশিষ্ট লোচন যার = বিলোচন
- পক্ক কেশ যার = পক্ককেশ
- হীন শক্তি যার = হীনশক্তি
- দৃঢ় প্রতিজ্ঞা যার = দৃঢ়প্রতিজ্ঞ
- বিশাল আকার যার = বিশালাকার
এরূপ : অল্পপ্রাণ, অল্পবয়স্ক, মন্দভাগ্য, উচ্চশির, সুশীল, সদর্থক, কদাকার, সতীর্থ, শ্যামাঙ্গ, নীলাম্বর, সিদ্ধার্থ, সুধী, কুবের, লেজকাটা, বিশালাক্ষ, মহাশয়, ঠোঁটকাটা, মাথা খারাপ, ঘরপোড়া, কঙ্কালসার, নদীমাতৃক, নীলকণ্ঠ, পীতাম্বর, দশানন, নতজানু, মতিচ্ছন্ন, হতশ্রী, সুশ্রী, হৃতসর্বস্ব, কমবখ্ত, বদবখ্ত ইত্যাদি।
২. ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি
Noun—Noun |
বিশেষ্য ও বিশেষ্য পদের মিলনে যে সমাস হয়, তাকে ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন–
- বীণা পাণিতে যার = বীণাপাণি
- শূল পাণিতে যার = শূলপাণি
- পাপে মতি যার = পাপমতি
- বোঁটা খসেছে যার = বোঁটাখসা
- নদী মাতা যার = নদীমাতৃক
- আশীতে বিষ যার = আশীবিষ
- কথা সর্বস্ব যার = কথাসর্বস্ব
- ঊর্ণ নাভিতে যার = ঊর্ণনাভ
- পদ্ম নাভিতে যার = পদ্মনাভ
- রত্ন গর্ভে যার = রত্নগর্ভা
- জ্ঞান গর্ভে যার = জ্ঞানগর্ভ
- কর্ণে ফুল যার = কর্ণফুলী
- মধু কণ্ঠে যার = মধুকণ্ঠ
- হাসি মুখে যার = হাসিমুখ
- ইতি আদিতে যার = ইত্যাদি
- খড়গ হস্তে যার = খড়গহস্ত
- মিলন অন্তে যার = মিলনান্তক
- অন্য বিষয়ে মন যার = অন্যমনস্ক
- অন্তঃ (অন্তরে) অপ্ যার = অন্তরীপ
এরূপ : বজ্ৰপাণি, কলকণ্ঠ, পাদপদ্ম, শশাঙ্ক, তুলনামূলক, চন্দ্রচূড়, ঘরমুখো, ছাপোষা, কানকাটা, পা-চাটা, পাতা-চাটা, পাতাছেঁড়া, ধামাধরা ইত্যাদি।
৩. মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি
মাঝের পদসমূহ লোপ পাবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো "অনুষ্ঠান" বোঝাবে, নয়তো কোনো "নারীকে" বোঝাবে; এবং ব্যাসবাক্যে অবশ্যই বহুব্রীহির বিশেষ শব্দাবলী তথা "যে/যার/যা" প্রভৃতি থাকবে। |
যে বহুব্রীহি সমাসে ব্যাসবাক্যের ব্যাখ্যামূলক মধ্যপদ লোপ পায়, তাকে মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন–
- গায়ে হলুদ দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে = গায়েহলুদ
- হাতে খড়ি দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে = হাতেখড়ি
- বিড়ালের ন্যায় চোখ যে নারীর = বিড়ালচোখী
- বউয়ের সম্মানে ভাত খাওয়ানো হয় যে অনুষ্ঠানে = বৌভাত
- রাখীভাই = রাখী বেঁধে ভাই সম্পর্ক পাতানো হয় যার সঙ্গে
- স্বর্ণের মতো আভা যার = স্বর্ণাভ
- তিমিরের (কালো) ন্যায় কুন্তল (চুল) যার = তিমিরকুন্তলা
- রসে পূর্ণ যে গোল্লা = রসগোল্লা
- মুলার ন্যায় দাঁত আছে যার = মুলাদাঁতী
- বিম্বের ন্যায় অধর যার = বিম্বাধরা
- ধর্মের (আদর্শের) উদ্দেশ্যে ঘট স্থাপনপূর্বক যে আন্দোলন = ধর্মঘট
- বিম্বের ন্যায় রঞ্জিত অধর যে নারীর = বিম্বাধরী
- মীনের অক্ষির মতো অক্ষি যে নারীর = মীনাক্ষী
- কাঞ্চনের প্রভার ন্যায় প্রভা যার = কাঞ্চনপ্রভ
এরূপ : মুখেভাত, মেনিমুখো, ঘরমুখো, মকরমুখো, বাঁদরমুখো, সোনামুখী, বিধুমুখী, বিড়ালাক্ষী, কপোতাক্ষ, চাঁদবদনী, চিরুণদাঁতি, মৃগনয়না, ডাকাবুকো, ক্ষুরধার, একবুক ইত্যাদি।
৪. সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি
যদি পূর্বপদ সংখ্যাবাচক হয়, পরপদ বিশেষ্য হয় এবং সমস্ত পদটি যদি বিশেষণ পদ বোঝায়, তাহলে তাকে সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন–
- চৌচালা = চৌ (চার) চাল যে ঘরের
- চার হাত পরিমাণ = চারহাতি
- চতুঃ (চার) ভুজ যার = চতুর্ভুজ
- পাঁচ সের পরিমাণ ওজন যার = পাঁচসেরী
- পঞ্চ আনন যার = পঞ্চানন
- দশ আনন যার = দশানন
- দুই নল যার = দু'নলা
- দশ গজ পরিমাণ দৈর্ঘ্য যার = দশগজি
এরূপ : দশমণি, শতচ্ছিন্ন, একতারা, দোতরা, সেতার, সাতনরী, তেপায়া, চৌচির, চতুর্দশপদি, ষড়ানন, দ্বীপ, একচোখো, চতুর্মুখ, ত্রিলোচন, সহস্রলোচন ইত্যাদি।
৫. ব্যতিহার বহুব্রীহি
পরস্পর ক্রিয়া বিনিময় বোঝাতে একই শব্দের পুনরুক্তি দ্বারা যে বহুব্রীহি সমাস হয়, তাকে ব্যতিহার বহুব্রীহি সমাস বলে। এ সমাসে পূর্বপদে ‘আ’ এবং পরপদে ‘ই’ যোগ হয়। যেমন–
- কোলে কোলে যে মিলন = কোলাকুলি
- বলায় বলায় যে কথা = বলাবলি
- কানে কানে যে কথা = কানাকানি
- বকায় বকায় যে বাকযুদ্ধ = বকাবকি
- লাঠিতে লাঠিতে যে মারামারি = লাঠালাঠি
- গলায় গলায় যে মিল = গলাগলি
- চুলে চুলে যে লড়াই = চুলোচুলি
- হেসে হেসে যে আলাপ/হাসতে হাসতে যে ক্রিয়া = হাসাহাসি
- কেশে কেশে আকর্ষণ করে যে যুদ্ধ = কেশাকেশি
- পরস্পরের মধ্যে আড়ি = আড়াআড়ি
- পরস্পরকে জানা = জানাজানি
এরূপ : ধস্তাধস্তি, গুঁতাগুঁতি, হাতাহাতি, রক্তারক্তি, খুনোখুনি, চোখাচোখি, দেখাদেখি, ঘুষাঘুষি, গালাগালি, কাড়াকাড়ি, গড়াগড়ি, বাঁধাবাঁধি, রাতারাতি, তর্কাতর্কি, টানাটানি ইত্যাদি।
৬. অলুক বহুব্রীহি
যে বহুব্রীহি সমাসে পূর্বপদ বা পরপদের বিভক্তি লোপ পায় না, তাকে অলুক বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন–
- মাথায় পাগড়ি যার = মাথায়পাগড়ি
- গায়ে হলুদ দেয়া হয় যে অনুষ্ঠানে = গায়েহলুদ
- গলায় গামছা যার = গলায়গামছা
- কানে খাটো যে = কানেখাটো
- হাতে খড়ি দেয়া হয় যে অনুষ্ঠানে = হাতেখড়ি
এরূপ : হাতেছড়ি, হাতেবেড়ি, পায়েবেড়ি, মাথায়ছাতা, মুখেভাত, খড়মপেয়ে, গায়েপড়া, কানেকলম ইত্যাদি।
৭. নঞ বহুব্রীহি
যে বহুব্রীহি সমাসে পূর্বপদে না-বাচক অব্যয় থাকে, তাকে নঞ বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন–
- নেই ভুল যার = নির্ভুল
- নেই অন্ত যার = অনন্ত
- নেই বিকল্প যার = নির্বিকল্প
- নেই থৈ যার = অথৈ
- নাই আদি যার = অনাদি
- নাই অন্ত যার = অনন্ত
- নাই হায়া যার = বেহায়া
- নাই মমতা যার = নির্মম
- অ (হয়না) মূল্য যার = অমূল্য
- অ (নেই) জ্ঞান যার = অজ্ঞান
- বি (নেই) শ্রী যার/ বি (বিগত) হয়েছে শ্রী যার = বিশ্রী
- বে (নেই) ইমান যার = বেইমান
- নিঃ (নেই) শঙ্কা যার = নিঃশঙ্ক
এরূপ : বেয়াদব, বেতার, বেসুরো, , বিপত্নীক, বেঁহুশ, বিশৃঙ্খল, বীতশোক, অপয়া, নির্জলা, অপ্রতিভ, অনর্থক, অচেতন, অজানা, নির্বোধ, নিরর্থক, নির্জন, নিলাজ, নিখুঁত, নিখোঁজ ইত্যাদি।
৮. প্রত্যয়ান্ত বহুব্রীহি সমাস
যে বহুব্রীহি সমাসের সমস্ত পদে আ, এ, ও ইত্যাদি প্রত্যয় যুক্ত হয়, তাকে প্রত্যয়ান্ত বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন–
- দুই দিকে টান যার = দোটানা
- এক দিকে চোখ যার = একচোখা
- নিঃ (নাই) খরচ যার = নিখরচে
- ঊন পাজর যার = ঊনপাঁজুরে
এরূপ : একরোখা, একগুঁয়ে, একঘরে, দোমনা, অকেজো, হাতিশুঁড়ো ইত্যাদি।
৯. সহাৰ্থক বহুব্রীহি সমাস
সহার্থক বা তুল্য পদের সাথে বিশেষ্য পদের যে বহুব্রীহি সমাস হয়, তাকে সহাৰ্থক বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন–
- বান্ধবের সহিত বর্তমান = সবান্ধব
- স্ত্রীর সহিত বর্তমান = সস্ত্রীক
- বাকের সাথে বর্তমান = সবাক
- পরিবারের সহিত বর্তমান = সপরিবার
- অর্থের সাথে বর্তমান = সার্থক
- অপেক্ষা সহ বর্তমান = সাপেক্ষ
- সহ তীর্থ যার = সতীর্থ
- শ্রদ্ধার সঙ্গে বর্তমান = সশ্রদ্ধ
- বেগের সঙ্গে বর্তমান = সবেগ
- প্রতিভার সহিত বর্তমান= সপ্রতিভ
- চকিতের সহিত বর্তমান= সচকিত
- অবধানের সঙ্গে বিদ্যমান = সাবধান
- ক্রিয়ার সঙ্গে বর্তমান = সক্রিয়
এরূপ : সবিনয়, সদয়, সাবলীল, সফল, সলজ্জ, স্বপত্নীক, সপুত্রক, সশরীর, সসম্মান, সতর্ক, সদর্প, সহৃদয়, সপ্রসঙ্গ, সলঙ্কারা ইত্যাদি।
১০. নিপাতনে সিদ্ধ বহুব্রীহি
যে বহুব্রীহি সমাস কোন নিয়মের অধীনে নয়, তাকে নিপাতনে সিদ্ধ বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন–
- পঞ্চ বটের সমাহার = পঞ্চবটী
- জীবিত থেকেও মৃত = জীবন্মৃত
- নরাকারের যে পশু = নরপশু
- অন্তর্গত অপ যার = অন্তরীপ
- দুদিকে অপ যার = দ্বীপ
- পণ্ডিত হয়েও যে মূর্খ = পণ্ডিতমূৰ্খ
বহুব্রীহি সমাসের সাধারণ নিয়ম
- সাধিত পদটি অনেক সময় বিশেষ্য হয়:
- পীত অম্বর যার = পীতাম্বর (শ্রীকৃষ্ণ)
- বীণা পাণিতে যার = বীণাপাণি (সরস্বতী)
- সাধিত পদটি অনেক সময় বিশেষণ হয়:
- মা মরেছে যার = মা-মরা
- সাধিত পদ ও সপ্তমী বিভক্তিযুক্ত পদ সাধারণত পূর্বপদে বসে:
- আশীতে বিষ যার = আশীবিষ (সাপ)
- ছন্নু মতি যার = মতিচ্ছন্ন [ব্যতিক্রম উদাহরণ]
- 'সহিত' ও 'সমান' শব্দের পরিবর্তে 'স' বা 'সহ' ব্যবহৃত হয়:
- সমান তীর্থ যার = সতীর্থ
- পরিবারের সহিত বর্তমান = সপরিবার
- সমান উদর যার = সহোদর
- স্ত্রীবাচক বোঝাতে সাধিত পদে সাধারণত 'আ' বা 'ঈ' যোগ হয়:
- নীল নয়ন যার = নীলনয়ন
- কোকিলের মতো কন্ঠ যার = কোকিলকণ্ঠী
- যদি 'সহ' কিংবা 'সহিত' শব্দের সাথে অন্য পদের বহুব্রীহি সমাস হয়, তখন প্রায়ই 'সহ' ও 'সহিত' স্থলে 'স' ব্যবহৃত হয়:
- বান্ধবসহ বর্তমান = সবান্ধব
- দর্পের সহিত বর্তমান = সদর্প
- পরস্পরিক একই ক্রিয়াতে বহুব্রীহি সমাসে, পূর্বপদ আ-কারান্ত এবং পরপদ ই-কারান্ত হয়:
- লাঠিতে লাঠিতে মারামারি = লাঠালাঠি
- হাতে হাতে যে লড়াই = হাতাহাতি
- ‘মহৎ’ শব্দের ক্ষেত্রে, পূর্বপদে 'মহা' বসে:
- মহৎ প্রাণ যার = মহাপ্রাণ
- মহৎ আশয় যার = মহাশয়
- কিছু ক্ষেত্রে সমস্ত পদে 'ক' যুক্ত হয়:
- নদী মাতা যার = নদীমাতৃক
- বিগত হয়েছে পত্নী যার = বিপত্নীক
- পরপদের ক্ষেত্রে, যদি আ-কার থাকে তবে তা অ-কারে রূপান্তরিত হয়:
- দৃঢ় প্রতিজ্ঞা যার = দৃঢ়প্রতিজ্ঞ
- নাই দয়া যার = নির্দয়
- এবং যদি পূর্বপদে অ-কার থাকে, তবে তা আ-কারে রূপান্তরিত হয়:
- বিশ্ব মিত্র যার = বিশ্বামিত্র
- কিছু বহুব্রীহি সমাসে বিশেষ শব্দের শেষে 'ই' যোগ হয়:
- দশ গজ পরিমাণ যার = দশগজি
- পাঁচ হাত লম্বা যা = পাঁচহাতি
- পাঁচ সের পরিমাণ যার = পাঁচসেরি
- বিশেষ ক্ষেত্রে 'অক্ষি' শব্দের পরিবর্তে 'অক্ষ' ব্যবহার হয়:
- বিরূপ অক্ষি যার = বিরূপাক্ষ
- বিশাল অক্ষি যার = বিশালাক্ষ
- কমলের ন্যায় অক্ষি যার = কমলাক্ষ
- কপোতের অক্ষির ন্যায় অক্ষি যার = কপোতাক্ষ
- 'নাভি' শব্দের পরিবর্তে 'নাভ' ব্যবহৃত হয়:
- ঊর্ণ নাভিতে যার = ঊর্ণনাভ (মাকড়সা)
- পদ্ম নাভিতে যার = পদ্মনাভ
- কিছু ক্ষেত্রে 'ধনু' শব্দের পরিবর্তে 'ধন্বা' রূপে ব্যবহৃত হয়:
- পুষ্প ধনু যার = পুষ্পধন্বা
- গাভীব ধনু যার = গাভীবধন্বা
- 'জায়া' শব্দের পরিবর্তে 'জানি' ব্যবহৃত হয়:
- দেবী জায়া যার = দেবজানি
- যুবতী জায়া যার = যুবজানি
দ্বিগু সমাস
সংখ্যা + Noun + সমাহার |
সংখ্যাবাচক বিশেষণ পূর্বে বসে সমষ্টি বা সমাহার বোঝালে দ্বিগু সমাস হয়। এ সমাসে সমস্তপদটি বিশেষ্য পদ হয়। দ্বিগু সমাসে প্রথম পদটি সংখ্যাবাচক হয় এবং পরপদটি বিশেষ্য হয়। সমস্ত পদটি দ্বারা সমষ্টি বা সমাহার বোঝায়। যেমন—
- তিন মাথার সমাহার = তেমাথা
- ত্রি/তিন প্রান্তরের সমাহার = ত্রিপ্রান্তর/তেপান্তর
- ত্রি (তিন) ফলের সমাহার = ত্রিফলা
- চার রাস্তার সমাহার = চৌরাস্তা
- চার মোহনার সমাহার = চৌমোহনী
- পাঁচ সেরের সমাহার = পসুরি
- সপ্ত অহের সমাহার = সপ্তাহ
- সপ্ত ঋষির সমাহার = সপ্তর্ষি
- শত অব্দের সমাহার = শতাব্দী
এরূপ : দ্বিপ্রহর, ত্রিকাল, ত্রিপদী, ত্রিভুবন, ত্রিমোহিনী, চতুষ্পদী, চতুর্দশপদী, চতুর্ভুজ, চতুরঙ্গ, পঞ্চভূত, পঞ্চবটী, পঞ্চনদ, পাঁচসালা, পাঁচফোড়ন, ষড়ঋতু, সপ্তরথী, সপ্তডিঙ্গা, সাতসমুদ্র, সাতনরী, অষ্টধাতু, অষ্টপ্রহর, নবরত্ন, নবগ্রহ, দশচক্র, দশদিগন্ত, তেরোনদী, শতবার্ষিকী ইত্যাদি।
Confusion Alert:
- সেতার — তিন তার আছে যার [সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি]
- সাত-পাঁচ — সাত ও পাঁচ [সংখ্যাবাচক দ্বন্দ্ব]
- চতুর্দোলা — চতুঃ বাহিত দোলা [মধ্যপদলোপী কর্মধারয়]
- চৌচালা — চার চালা আছে যে ঘরের [সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি]
- তেপায়া — তিন পায়া যার [সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি]।
অব্যয়ীভাব সমাস
'অব্যয়ীভাব’ অর্থ অব্যয়ের ভাব বর্তমান। যে সমাসে পূর্বপদে অব্যয় থাকে এবং অব্যয়ের অর্থই প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয়, তাকে অব্যয়ীভাব সমাস বলে। অব্যয়ীভাব সমাসে কেবলমাত্র অব্যয়ের অর্থযোগে ব্যাসবাক্য গঠিত হয়। যেমন— পর্যন্ত, অভাব, পশ্চাৎ, যোগ্যতা, সাদৃশ্য, সামীপ্য, বীপ্সা, ঈষৎ, ক্ষুদ্র, বিরোধ, অতিক্রান্ত, অনতিক্রম্যতা ইত্যাদি অর্থে অব্যয়ীভাব সমাস হয়।
"অব্যয়ীভাব সমাসের ক্ষেত্রে ব্যাসবাক্যে 'সমীপে, সদৃশ, মতো, পুনঃপুনঃ, অভাব, পর্যন্ত, অতিক্রম না করে, অধিকার করে, অতিক্রান্ত, বিরুদ্ধ, যোগ্য, ক্ষুদ্র, সকলেই, পশ্চাৎ, ঈষৎ' প্রভৃতি থাকবে এবং সমস্ত পদের প্রথমে উপসর্গ যেমন: 'উপ, অনু, প্রতি, দূর, আ, যথা' ইত্যাদি থাকবে এবং পূর্ব পদের অর্থ প্রাধান্য পাবে। উপসর্গকে অব্যয়জাত শব্দাংশ বলা হয়।
- পর্যন্ত অর্থে—
- জীবন পর্যন্ত = আজীবন
- মরণ পর্যন্ত = আমরণ
- শৈশব থেকে আরম্ভ করে = আশৈশব
- বাল্য হইতে = আবাল্য
- কণ্ঠ পর্যন্ত = আকণ্ঠ
- কর্ণ পর্যন্ত = আকর্ণ
- মূল পর্যন্ত = আমূল
- দিগন্ত পর্যন্ত = আদিগন্ত
- আদি হইতে অন্ত পর্যন্ত = আদ্যন্ত
- পা থেকে মাথা পর্যন্ত = আপাদমস্তক
- সমুদ্র হতে হিমাচল পর্যন্ত = আসমুদ্রহিমাচল
- জানু পর্যন্ত লম্বিত = আজানুলম্বিত
- অভাব অর্থে-
- মিলের অভাব = গরমিল
- তালের অভাব = হরতাল
- শ্রীর অভাব = বিশ্রী
- ভিক্ষার অভাব = দুর্ভিক্ষ
- ভাতের অভাব = হাভাত
- ঘরের অভাব = হাঘর
- নুনের/লবণের অভাব = আলুনি
- জনের অভাব = নির্জন
- আমিষের অভাব = নিরামিষ
- বিঘ্নের অভাব = নির্বিঘ্ন
- ভাবনার অভাব = নির্ভাবনা
- জলের অভাব = নির্জল
- উৎসাহের অভাব = নিরুৎসাহ
- পশ্চাৎ অর্থে—
- ক্রমের পশ্চাৎ = অনুক্রম
- তাপের পশ্চাৎ = অনুতাপ
- রাগের পশ্চাৎ = অনুরাগ
- ধাবনের পশ্চাৎ = অনুধাবন
- গমনের পশ্চাৎ = অনুগমন
- রণনের পশ্চাৎ = অনুরণন
- যোগ্যতা অর্থে—
- প্রেরণার যোগ্য = অনুপ্রেরণা
- গুণের যোগ্য = অনুগুণ
- রূপের যোগ্য = অনুরূপ
- ভাবের যোগ্য = অনুভাব
- সাদৃশ্য অর্থে—
- নদীর সদৃশ = উপনদী
- দ্বীপের সদৃশ = উপদ্বীপ
- বনের সদৃশ = উপবন
- ভাষার সদৃশ = উপভাষা
- গ্রহের তুল্য = উপগ্রহ
- শহরের সদৃশ = উপশহর
- মূর্তির সদৃশ = প্রতিমূর্তি
- ধ্বনির সদৃশ = প্রতিধ্বনি
- ধ্যানের সদৃশ = অনুধ্যান
- দানের সদৃশ = অনুদান
- সামীপ্য অর্থে—
- কণ্ঠের সমীপে = উপকণ্ঠ
- অক্ষির সমীপে = সমক্ষ
- কূলের সমীপে = উপকূল
- নগরীর সমীপে = উপনগরী
- বীপ্সা(পুনরাবৃত্তি) অর্থে—
- দিন দিন = প্রতিদিন
- গৃহে গৃহে = প্রতিগৃহে
- বার বার = প্রতিবার
- ক্ষণে ক্ষণ = প্রতিক্ষণে
- ক্ষণ ক্ষণ = অনুক্ষণ
- রোজ রোজ = হররোজ
- দম দম = হরদম
- বছর বছর = ফি-বছর
- ঈষৎ অর্থে—
- ঈষৎ নত = আনত
- ঈষৎ রক্তিম = আরক্তিম
- ক্ষুদ্র অর্থে—
- ক্ষুদ্র অঙ্গ = প্রত্যঙ্গ
- ক্ষুদ্র শাখা = প্রশাখা
- ক্ষুদ্র বিভাগ = উপবিভাগ
- জেলার ক্ষুদ্র = উপজেলা
- ক্ষুদ্র জাতি = উপজাতি
- ক্ষুদ্ৰ নদী = উপনদী/শাখানদী
- ছোট সাগর = উপসাগর
- ছোট দ্বীপ = উপদ্বীপ
- বিরোধ অর্থে—
- বিরুদ্ধ কূল/কূলের বিপরীতে = প্রতিকূল
- বিরুদ্ধ বাদ = প্রতিবাদ
- ঘাতের বিরুদ্ধে = প্রতিঘাত
- বিরুদ্ধ পক্ষ = প্রতিপক্ষ
- পক্ষের বিপরীতে = বিপক্ষ
- ক্রিয়ার বিপরীতে = প্রতিক্রিয়া
- শোধের বিপরীতে = প্রতিশোধ
- দানের বিপরীতে = প্রতিদান
- সম্মুখে/পক্ষে অর্থে—
- অক্ষির সম্মুখে= প্রত্যক্ষ
- কূলের পক্ষে = অনুকূল
- প্রবেশের পক্ষে = অনুপ্রবেশ
- অতিক্রান্ত অর্থে—
- বেলাকে অতিক্রান্ত = উদ্বেল
- শৃঙ্খলাকে অতিক্রান্ত = উচ্ছৃঙ্খল
- শ্বাসকে অতিক্রান্ত = উচ্ছ্বাস
- মাত্রাকে অতিক্রান্ত = অতিমাত্রা
- মানবকে অতিক্রান্ত = অতিমানব
- অনতিক্রম্যতা অর্থে—
- রীতিকে অতিক্রম না করে= যথারীতি
- বিধিকে অতিক্রম না করে= যথাবিধি
- শাস্ত্রকে অতিক্রম না করে= যথাশাস্ত্র
- সাধ্যকে অতিক্রম না করে= যথাসাধ্য
- ক্রমকে অতিক্রম না করে = যথাক্রম
- যোগ্যতাকে অতিক্রম না করে= যথাযোগ্য
- ইচ্ছাকে অতিক্রম না করে= যথেচ্ছা
- ইষ্টকে অতিক্রম না করে= যথেষ্ট
- বিবিধ অর্থে—
- পিতামহের পূর্ব = প্রপিতামহ
- দস্তুর অনুযায়ী = দস্তুরমতো
- হীন দেবতা = উপদেবতা
- মুখের অভিমুখে = সম্মুখ
- আত্মাকে অধিকার করিয়া = অধ্যাত্ম
আরও কিছু উদাহরণ : আমৃত্যু[৫৪], পরোক্ষ, প্রতিবিম্ব, প্রতিচ্ছায়া, প্রতিচ্ছবি, প্রত্যুত্তর, সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ ইত্যাদি।
প্রাদি সমাস
অধিকাংশ উদাহরণে "প্র" উপসর্গটি থাকে |
প্রকৃষ্ট/প্রকৃষ্টরূপে ⇌ প্র |
পরিপার্শ্বে/চতুর্দিকে ⇌ পরি |
পশ্চাতে ⇌ অনু |
প্রাদি সমাস মূলত অব্যয়ীভাব সমাসের অন্তর্গত। গঠনের দিক থেকে বিবেচনা করলে, অব্যয়ীভাবের মতোই প্রথমে উপসর্গ এবং পরে কৃত প্রত্যয়ের সাথে সংযুক্ত হয়ে প্রাদি সমাস গঠিত হয়। তবে অব্যয়ীভাবের সাথে মূল পার্থক্য হল প্রাদি সমাসের পূর্বপদে উপসর্গের প্রাধান্য থাকে, বিশেষ করে সংস্কৃত উপসর্গযোগে (প্র,পরা,অপ,সম,নি,অব,অনু,পরি ইত্যাদি) গঠিত হয়। সংস্কৃত উপসর্গ মোট ২০টি। মনে রাখার জন্য প্রাদি=প্র+আদি। এখানে প্র একটি সংস্কৃত উপসর্গ। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত প্রাদি সমাসগুলো নিচে দেওয়া হল:
- প্র (প্রকৃষ্ট) যে বচন = প্রবচন
- পরি (চতুর্দিকে) যে ভ্রমণ = পরিভ্রমণ
- অনুতে (পশ্চাতে) যে তাপ =অনুতাপ
- প্র (প্রকৃষ্ট রূপে) ভাত (আলোকিত) = প্রভাত
- প্র (প্রকৃষ্ট রূপে) গতি = প্রগতি
- প্র (প্রগত) পিতামহ = প্রপিতামহ
এরূপ: প্রকাশ[৫৫], প্রবাদ[৫৬], প্রভাব[৫৭], প্রদর্শন[৫৮], প্রনাম[৫৯], সমাদর[৬০] ইত্যাদি।
নিত্য সমাস
অধিকাংশ উদাহরণে "অন্তর" শব্দটি থাকে |
অধিকাংশ ব্যাসবাক্যে "অন্য","কেবল" বা "ঈষৎ" শব্দগুলি থাকে |
অন্তর ⇌ অন্য |
মাত্র ⇌ কেবল/শুধু |
সুদ্ধ ⇌ সমস্ত |
বর্ণ/দশা+চে/টে ⇌ ঈষৎ |
টি/খানা ⇌ একটি |
যে সমাসে সমস্যমান পদগুলো পাশাপাশি অবস্থান করে এবং ব্যাসবাক্যের প্রয়োজন হয় না তাকে নিত্য সমাস বলে। যেমন— কাঁচা কলা = কাঁচকলা এখানে 'কাঁচকলা' নিত্যসমাস, কারণ 'কাঁচকলা' একটি বিশেষ ধরণের কলা বোঝায়।
- 'অন্য' যোগে:
- অন্য দেশ = দেশান্তর
- অন্য গৃহ = গৃহান্তর
- অন্য গ্রাম = গ্রামান্তর
- অন্য রূপ = রূপান্তর
- অন্য হস্ত = হস্তান্তর
- অন্য গতি = গত্যন্তর
- 'কেবল' বা 'শুধু' যোগে:
- কেবল তা = তন্মাত্র
- কেবল নাম = নামমাত্র
- কেবল জল = জলমাত্র
- কেবল দর্শন = দর্শনমাত্র
- কেবল শোনা = শোনামাত্র
- কেবল একটি = কেবলমাত্র
- শুধু কিছু = কিছুমাত্র
- শুধু চিহ্ন = চিহ্নমাত্র
- 'সুদ্ধ' যোগে:
- সমস্ত গ্রাম = গ্রামসুদ্ধ
- সমস্ত পাড়া = পাড়াসুদ্ধ
- সারা দিন = দিনভর
- 'বর্ণ/দশা/সংখ্যা' যোগে:
- ঈষৎ নীলবর্ণ = নীলাভ
- ঈষৎ লাল = লালচে
- ঈষৎ কৃষ্ণ/কালো = কালচে
- ঈষৎ রক্তবর্ণ = আরক্ত
- ঈষৎ ঘোলা = ঘোলাটে
- ঈষৎ রুগ্ন/রোগা = রোগাটে
- দুই এবং নব্বই = বিরানব্বই
- তুমি,আমি ও সে = আমরা
- একটি লোক = লোকটি
- এক জন = জনৈক্য
- একটি কাপড় = কাপড়খানা
- অনেক মানুষ = মানুষগুলো
- 'তুল্য' যোগে:
- বজ্রের তুল্য = বজ্রসন্নিভ
- দুগ্ধ ফেনার তুল্য = দুগ্ধফেননিভ
- জবাকুসুমের তুল্য = জবাকুসুমসঙ্কাশ
- কাল(যম) তুল্য সাপ = কালসাপ (কালো বর্ণের সাপ বোঝায় না, বরং ভীষণ বিষাক্ত সাপকে বোঝায়।)
- সর্বদাই সমাসবদ্ধ এমন নিত্যসমাস:
- কৃষ্ণসর্প = কৃষ্ণসর্প
- দাঁড়কাক = দাঁড়কাক
এরূপ : বাক্যান্তর[৬১], কালান্তর[৬২], মতান্তর[৬৩], স্থানান্তর[৬৪], ভাষান্তর[৬৫], দিনান্তর[৬৬], মাসান্তর[৬৭], দ্বীপান্তর[৬৮], যুগান্তর[৬৯], উপয়ান্তর[৭০], ধর্মান্তর[৭১], ভাবান্তর[৭২], পক্ষান্তর[৭৩], জন্মান্তর[৭৪], লোকান্তর[৭৫] ইত্যাদি।
Confusion Alert: "তেপান্তর" শব্দটির ব্যাসবাক্য হলো: তিন প্রান্তের/প্রান্তরের সমাহার। এটি দ্বিগু সমাসের উদাহরণ। কেননা এখানে "অন্তর" শব্দটি নেই বরং "প্রান্তর" শব্দটি রয়েছে।
অন্যান্য সমাস
অলুক/অলোপ সমাস
'লুক' কথার অর্থ হল 'লোপ'। অলুক সমাস আলাদা কোন সমাস নয়, যে কোন সমাস অলুক হতে পারে। যেমন অলুক দ্বন্দ্ব,অলুক তৎপুরুষ, অলুক বহুব্রীহি। এখন প্রশ্ন হল অলুক কেন হয় বা কিসের জন্য অলুক বলা হয়? যে সমাসের সমস্তপদে ব্যাসবাক্যের বিভক্তি লোপ পায় না তাদের অলুক সমাস বলে । সাধারণত দ্বন্দ্ব, তৎপুরুষ ও বহুব্রীহি সমাসে অলুক সমাস দেখা যায়। যেমন—
- অলুক দ্বন্দ্ব—
- মায়ে ও ঝিয়ে = মায়ে-ঝিয়ে
- হাটে ও বাজারে = হাটে-বাজারে
- চোখে ও মুখে = চোখেমুখে
- আগে ও পিছে = আগেপিছে
- অলুক তৎপুরুষ—
- পড়ার জন্য ঘর = পড়ার ঘর
- মেঘ দ্বারা ঢাকা = মেঘে ঢাকা
- অলুক বহুব্রীহি—
- মুখে মধু যার = মুখে মধু
বাক্যাশ্রয়ী সমাস
যে সমাসে সমাসবদ্ধ পদগুলি একমাত্রায় লেখা হয় না এমনকি সবসময় পদসংযোজক চিহ্ন দ্বারাও যুক্ত করে লেখা হয় না, অর্থাৎ বিচ্ছিন্নভাবে লিখিত এই সমাসকে বলা হয় বাক্যাশ্রয়ী সমাস। সহজ কথায় যে সমাসের সমস্তপদগুলো একটি মাত্র শব্দে পরিণত করা যায় না তাকেই বাক্যাশ্রয়ী সমাস বলে। কিছু উদাহরণ:
- রক্তকে দান (কর্ম তৎপুরুষ), তার জন্য শিবির (নিমিত্ত তৎপুরুষ) = রক্তদানশিবির
- সবুজকে বাঁচাও (কর্ম তৎপুরুষ), তার জন্য কমিটি (নিমিত্ত তৎপুরুষ)= সবুজ-বাঁচাও-কমিটি
- চক্ষুর অপারেশন (সম্বন্ধ তৎপুরুষ), তার জন্য শিবির (নিমিত্ত তৎপুরুষ) = চক্ষু-অপারেশন-শিবির
- গল্পকে বলা (কর্ম তৎপুরুষ), তার প্রতিযোগিতা (সম্বন্ধ তৎপুরুষ) = গল্পবলা-প্রতিযোগিতা
এরূপ : বসে-আঁকো-প্রতিযোগিতা, সব-পেয়েছির-দেশ, সব-পেয়েছির-দল, গ্রাম-রক্ষা-কমিটি, ডানকুনি-জুনিয়র-স্পোর্টিং-ক্লাব, পশ্চিমবঙ্গ-মাদ্রাসা-শিক্ষা-পরিষদ ইত্যাদি।
সহসুপা/সুপসুপা সমাস
ভিন্ন বিভক্তি যুক্ত দুটি পদের সমাস যে গুলোকে সাধারণত সমাসের কোন শ্রেণীতে ফেলা যায় না তাদেরকে সুপসুপা সমাস বলে।
যেমন- মায়ে-ঝিয়ে, এক্ষেত্রে দুটি পদেই একই বিভক্তি(এ) যুক্ত তাই এটি সুপসুপা সমাস নয়। আবার নৌকার ডুবি = নৌকাডুবি, সমস্যমান পদ দুটিতে যথাক্রমে ষষ্ঠী ও শুন্য বিভক্তি থাকলেও এরা সুপসুপা সমাস নয়, কেননা নৌকাডুবি ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাসের উদাহরণ। রাত্রির পূর্ব = পূর্বরাত্রি, রাত্রির মধ্য = মধ্যরাত্রি, পূর্বে ভূত = ভূতপূর্ব । এগুলো সহসুপা সমাসের উদাহরণ।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, এটি সপ্তমী তৎপুরুষ থেকে কিছুটা আলাদা। কেননা ভূতপূর্ব, শ্রুতপূর্ব, অদৃষ্টপূর্ব সব ক্ষেত্রে ‘পূর্ব’ শব্দটি পরে বসেছে। প্রত্যেকটি সমাসের ক্ষেত্রেই এরকম সুনির্দিষ্ট ভিন্নতা পরিলক্ষিত হলে সুপসুপা সমাস হয়।
ব্যাসবাক্য
- ↑ সাপে ও নেউলে
- ↑ পথে ও প্রান্তরে
- ↑ হেসে ও খেলে
- ↑ বনে ও বাঁদাড়ে
- ↑ কালো যে পেঁচা
- ↑ লাল যে ফুল
- ↑ ফুল যে বাবু
- ↑ পূর্ণ যে চন্দ্র
- ↑ নয়া যে দিল্লী
- ↑ কাঁচা যে কলা
- ↑ শ্বেত যে পাথর
- ↑ রুদ্র যে বীণা
- ↑ প্রধান যে শিক্ষক/হেড যে মাস্টার
- ↑ গুণী যে জন
- ↑ ছিন্ন যে পত্র
- ↑ ঝরা যে পাতা
- ↑ টক যে দই
- ↑ যা সাদা তাই সিধে
- ↑ যা বাঁধা তাই ধরা
- ↑ যিনি দীন তিনিই হীন
- ↑ যিনি গিন্নি তিনিই মা
- ↑ যিনি বধূ তিনিই মাতা
- ↑ যিনি লাট তিনিই সাহেব
- ↑ যে খোকা সেই বাবু
- ↑ যে দাদা সেই বাবু
- ↑ যিনি দাদা তিনিই ঠাকুর
- ↑ যিনি রাজা তিনিই সন্ন্যাসী
- ↑ বিজয় সূচক পতাকা
- ↑ জয় সূচক ধ্বনি
- ↑ জীবিত থেকেও যে মৃত
- ↑ কাঁচা অবস্থায় কলা
- ↑ ডাক ফেলার বাক্স
- ↑ হাঁটু পরিমান জল
- ↑ জয় সূচক মুকুট
- ↑ সন্ধ্যায় জ্বালানো প্রদীপ
- ↑ ধর্ম রক্ষার্থে ঘট
- ↑ গীতি সংবলিত কবিতা
- ↑ মমতা মিশ্রিত রস
- ↑ পানা ভরা পুকুর
- ↑ বাহু লতার ন্যায়
- ↑ বদন চন্দ্রের ন্যায়
- ↑ নর সিংহের ন্যায়
- ↑ পদ পল্লবের ন্যায়
- ↑ অধর পল্লবের ন্যায়
- ↑ মুখ চাঁদের ন্যায়
- ↑ মুখ সোনার ন্যায়
- ↑ লোচন/আঁখি পদ্মের ন্যায়
- ↑ কুমারী ফুলের ন্যায়
- ↑ কথা অমৃতের ন্যায়
- ↑ বাহু বল্লরীর ন্যায়
- ↑ পদ লোহার ন্যায়
- ↑ নয়ন কমলের ন্যায়
- ↑ মন বিহঙ্গের ন্যায়
- ↑ মৃত্যু পর্যন্ত
- ↑ প্র (প্রকৃষ্ট রূপে) কাশ
- ↑ প্র (প্রকৃষ্ট রূপে) বাদ
- ↑ প্র (প্রকৃষ্ট রূপে) ভাব
- ↑ প্র (প্রকৃষ্ট রুপে) দর্শন
- ↑ প্র (প্রত্যয়) দ্বারা নাম
- ↑ সম্ (সম্যক) যে আদর
- ↑ অন্য বাক্য
- ↑ অন্য কাল
- ↑ অন্য মত
- ↑ অন্য স্থান
- ↑ অন্য ভাষা
- ↑ অন্য দিন
- ↑ অন্য মাস
- ↑ অন্য দ্বীপ
- ↑ অন্য যুগ
- ↑ অন্য উপায়
- ↑ অন্য ধর্ম
- ↑ অন্য ভাব
- ↑ অন্য পক্ষ
- ↑ অন্য জন্ম
- ↑ অন্য লোক