বিষয়বস্তুতে চলুন

নাফ যুদ্ধ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
নাফ সংঘাত
তারিখ৮‒১০ জানুয়ারি, ২০০০ অথবা ৮-১৩ জানুয়ারি ২০০১
অবস্থান
ফলাফল
  • বাংলাদেশের কৌশলগত বিজয়
  • চুক্তি সম্পন্ন
বিবাদমান পক্ষ
বাংলাদেশ বিডিআর মিয়ানমার মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
আ ল ম ফজলুর রহমান জেনারেল থান শি
শক্তি
২৫০০ ২৫
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
অজানা। বাংলাদেশের দাবি: ৬০০ জন নিহত।[যাচাইকরণ ব্যর্থ হয়েছে]

নাফ যুদ্ধ ২০০০ সালের ৮ জানুয়ারিতে বাংলাদেশ রাইফেলস (বর্তমান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ও বার্মা সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর মধ্যে সংঘটিত একটি যুদ্ধ।[][] ১৯৯০-এর দশকে, সীমান্ত বরাবর প্রায়ই সংঘর্ষ হতো, যার মধ্যে রোহিঙ্গা সংহতি সংস্থা (আরএসও)-এর মতো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গেও সংঘর্ষ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এসব সংঘর্ষে স্থলমাইনের কারণে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সামরিক সদস্যদের মৃত্যু হয়েছিল, যার মধ্যে ১১ জন প্রহরী, ৩৫ জন বাংলাদেশি কাঠুরে এবং ২২টি হাতি নিহত হয়। নাফ নদীর সীমারেখা নিয়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়, যা ১৯৯৮ সালে সীমানা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে নিরসন করা হয়। চূড়ান্ত বিরোধ মিয়ানমার কর্তৃক একটি খালের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে ২০০০ সালের এপ্রিল মাসে মীমাংসিত হয়।[] এরপর ২০০১ সালে, একটি বাঁধ নির্মাণকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের পর একটি যৌথ জরিপ কমিশন গঠন করা হয়।[] মেজর রশিদের মতে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে "নাফ যুদ্ধ" নামে কোনো যুদ্ধ হয়েছে এই দাবির মধ্যে "কোনো সত্যতা" নেই। তিনি বলেন, জেনারেল ফজলুর রহমান মিথ্যাভাবে দাবি করেছিলেন যে তিনি একটি যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন যেখানে তিনি ৬০০ প্রতিপক্ষকে হত্যা করেছেন, অথচ কোনো হতাহত হয়নি। জাগো নিউজের সমসাময়িক বিষয়ক সম্পাদক তানভীর আহমেদ ব্যাখ্যা করেছেন যে ২০০০ সালের সংঘর্ষটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে তিনটি সংঘর্ষের একটি ছিল, যার মধ্যে ১৯৯৮ এবং ২০০৫ সালের আরও দুটি একই রকম সংঘর্ষ অন্তর্ভুক্ত।[] সংঘর্ষটি তিন দিন স্থায়ী হয়েছিল। বাংলাদেশ রাইফেলস ২,৫০০ জন সদস্য মোতায়েন করেছিল। সেই সময়ের নিরপেক্ষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে মাত্র ২৫টি সতর্কতামূলক গুলি চালানো হয়েছিল এবং ঘটনাটি ২০০০ সালে নয়, ২০০১ সালে ঘটে।[]

পটভূমি

[সম্পাদনা]

১৯৬৬ সালে সীমান্ত নিষ্পত্তিকরণের সময় তৎকালীন পাকিস্তান ও বার্মা সরকার একটি চুক্তিতে উপনীত হয়। এই চুক্তির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সমসাময়িক সময়ের নাফ নদীর খাতের মধ্যস্থিত অংশকে দুই দেশের সীমান্ত রূপে নির্দিষ্ট করা হয়। মায়ানমারের অংশে নাফ নদীর বারোটি প্রশাখা আছে। চুক্তি অনুযায়ী যেহেতু নাফ নদীর খাতের মধ্যভাগকেই আন্তর্জাতিক সীমারেখা হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছিল তাই মিয়ানমার সেই প্রশাখাসমূহে এমন কোন পদক্ষেপ নিতে পারতো না, যা নাফ নদীর গতিপথে বড়সড় পরিবর্তন আনতে পারে। কিন্তু মিয়ানমার এই চুক্তি অগ্রাহ্য করে ২০০০ সাল নাগাদ বারোটির মধ্যে এগারোটি নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে। এতে করে নাফ নদীর মূল প্রবাহ বাংলাদেশের দিকে সরে আসে এবং প্রায় ২৫০০ একর ভূখণ্ড বাংলাদেশের ভূসীমা থেকে হারিয়ে যায়।[]

২০০০ সালে মিয়ানমার সর্বশেষ প্রশাখাতেও বাঁধ দিতে উদ্যোগী হলে উভয় দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়। এই বাঁধ হয়ে গেলে নাফ নদীর বাংলাদেশ অংশে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিলো, যাতে টেকনাফ শহরের অস্তিত্ব বিলীন হতে পারতো তাই বাংলাদেশ রাইফেলস ১৯৬৬ সালের চুক্তি মোতাবেক বাধ নির্মাণ না করতে অনুরোধ জানালে মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষাবাহিনী অশোভন ও অপেশাদারী ভাষায় চিঠি পাঠায়।[]

From NASAKA HQ to BDR HQ Bangladesh. We are warning you to behave otherwise we will teach you lessons you will never forget.
[নাসাকা সদরদপ্তর থেকে বিডিআর সদরদপ্তর বাংলাদেশ। সুন্দরভাবে আচরণ করতে আমরা আপনাদের সতর্ক করছি অন্যথায় আমরা আপনাদের এমন শিক্ষা দেব যা আপনারা কখনও ভুলবেন না।]

কূটনৈতিক আলোচনা ব্যর্থ হলে সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাঁধ দেওয়া রোধ করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ রাইফেলস।[]

ইতিহাস

[সম্পাদনা]

সামরিক অবস্থানগত দিক থেকে বাংলাদেশের সামরিক অবস্থান ছিল মিয়ানমারের অবস্থানের থেকে কিছুটা নিচে। তবে বাংলাদেশ রাইফেলস সম্ভাব্য যুদ্ধের পরিণতি নির্ধারণকারী বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন গোলাবারুদের পর্যাপ্ততাকে।[]

তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমানের বক্তব্যে জানা যায় তিনি যুদ্ধ শুরুর আগের রাতে মর্টারের গোলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পঁচিশ লাখ গোলাবারুদ কক্সবাজারে পাঠিয়ে দেন। এর মধ্যে অর্ধেক তিনি কক্সবাজারে মোতায়েন রাখার আদেশ দেন, আর বাকি গোলাবারুদ মূল রণাঙ্গনে পাঠিয়ে দেন।[]

মূল যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো ২০০০ সালের ৮ই জানুয়ারি দুপুর আড়াইটায়। জেনারেল ফজলুর রহমান সেদিন নিয়মিত সীমান্ত পরিদর্শনের অংশ হিসেবে দিনাজপুরে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকেই তিনি বিসমিল্লাহ বলে একটি কোড ওয়ার্ডের মাধ্যমে অপারেশন শুরুর আদেশ দেন।[][]

যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিলো টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নে তোতার দ্বীপ সংলগ্ন অঞ্চলে। এখানে নাফ নদীর একটি বাঁকের সামনে প্রথম গুলি শুরু করে বিডিআর। অতর্কিত হামলায় মিয়ানমারের প্রায় ছয় শতাধিক সৈন্য, ও বাঁধ নির্মাণের শ্রমিক নিহত হয়। যুদ্ধে বার্মার সেনা সমাবেশ ও হতাহতের খবর গোয়েন্দা সূত্রে প্রাপ্ত। যুদ্ধের কিছু আগেই বেশ কিছু গোয়েন্দাকে বার্মায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো তথ্য সংগ্রহের জন্য। তাদের থেকে তথ্য পাওয়া যায় একজন মেজর জেনারেল ও একজন রিয়ার এডমিরালের অধীনে বার্মার নিয়মিত বাহিনীর ২৫০০০ সৈন্য রণাঙ্গনে উপস্থিত হয়েছিলো। সেই তুলনায় বাংলাদেশের সামরিক প্রস্তুতি ছিল খুবই অপ্রতুল (মাত্র ২৫০০ নিয়মিত সেনা সদস্য) তৎকালীন ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা রাজ্য শান্তি ও উন্নয়ন পরিষদ নামের একটি পরিষদ মিয়ানমারের সরকারে অধিষ্ঠ ছিলো। এই পরিষদের চেয়ারম্যান সিনিয়র জেনারেল থান শোয়ে ছিলেন মায়ানমারের সরকার প্রধান, সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক।[]

জেনারেল থান শোয়ে ৯ জানুয়ারি রেঙ্গুনে নিযুক্ত বিদেশী সাংবাদিক ও রাষ্ট্রদূতদের তলব করে ঘোষণা করেন যে-

আমরা চাই বাংলাদেশ ও আমরা কোনোরূপ পূর্বশর্ত ছাড়া একসাথে আলোচনায় বসে বিবাদমান বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি করি।

এছাড়াও তিনি আক্রমণ বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশের কাছে মিয়ানমার একটি চিঠি পাঠান।[]

যুদ্ধ বিরতি

[সম্পাদনা]

যুদ্ধ থেকে একতরফা প্রত্যাহারের কারণে ১০ জানুয়ারী নাগাদ যুদ্ধ স্তিমিত হয়ে পড়ে। বার্মার নিঃশর্ত আলোচনার প্রস্তাব গ্রহণ করে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল মংডু গমন করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন যুগ্মসচিব (রাজনৈতিক) জানিবুল হকের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের প্রস্তাবনা তুলে ধরে। মিয়ানমারের পক্ষ হতে কোন টাইপ রাইটার সরবরাহ না করা হলে সভায় হাতে লেখা একটি অঙ্গীকারনামা স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে ভবিষ্যতে কখনো নাফ নদীতে কোন রূপ বাঁধ নির্মাণের প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকার ওয়াদা করে মিয়ানমার সরকার।[][]

পরবর্তী

[সম্পাদনা]

যুদ্ধের ব্যাপ্তি ও মেয়াদের দিক থেকে নাফ যুদ্ধ স্বল্পস্থায়ী হলেও এই যুদ্ধ একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বিস্তার করে। এই যুদ্ধের পর থেকে সীমান্তরক্ষী বাহিনী পর্যায়ে নিয়মিত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়া শুরু হয়। যুদ্ধে বিজয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ তৎকালীন সরকার যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক সৈনিককে অপারেশন নাফ পদক নামে একটি বীরত্বসূচক তাম্রপদক প্রদান করে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বিডিআর সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ ছাড়াই কোন যুদ্ধে একক বিজয় লাভ করে। এছাড়াও নাফ যুদ্ধে সবচেয়ে বিরল যে কৃতিত্ব বিডিআর অর্জন করে, তা হচ্ছে শূন্য মৃত্যুহার। তিনদিন ব্যাপী ঘোরতর যুদ্ধে বার্মার তরফে ছয় শতাধিক ব্যক্তি নিহত হলেও বিডিআরে একজনেরও প্রাণহানি ঘটেনি। শুধুমাত্র কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছিলেন।[][]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অস্ত্র ও গ্যাসপ্রবাহ"। প্রথম আলো। 
  2. "বাংলাদেশ মিয়ানমার যুদ্ধ : প্রসঙ্গ ও বাস্তবতা"জাগো নিউজ। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-০৬ 
  3. van Schendel, Willem (৭ সেপ্টেম্বর ২০০৬)। "Guns and Gas in Southeast Asia: Transnational Flows in the Burma-Bangladesh Borderland"Kyoto Review of Southeast Asia (ইংরেজি ভাষায়)। 
  4. van Schendel, Willem (১৭ এপ্রিল ২০১৭)। "Arms and Gas Flow in Southeast Asia along the Myanmar-Bangladesh Border"Protichinta। Joshita Jihan কর্তৃক অনূদিত। দৈনিক প্রথম আলো। 
  5. "Bangladesh-Myanmar War: Context and Reality"Jago News। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-০৬ 
  6. "Bangladesh-Burma border clash"BBC। ৮ জানুয়ারি ২০০১। 
  7. "নাফ যুদ্ধঃ বিডিআরের অসীম সাহসিকতার গল্প"আলো.কম.বিডি। ২৪ জানুয়ারি ২০২১। ২৪ জুন ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুন ২০২১ 
  8. "বাঙালি সেনাদের আরেকটি গৌরভ গাঁথা, নাফ যুদ্ধ, বাংলাদেশ বনাম মিয়ানমার, কি হয়েছিলো সে দিন?"Online Bangla News (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২১-০২-২১। ২০২২-১০-০২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-০৬