দীক্ষা (ভারতীয় ধর্ম)
হিন্দুধর্ম |
---|
ধারাবাহিকের অংশ |
![]() |

দীক্ষা (সংস্কৃত: दीक्षा) হলো "ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি বা পবিত্রতা" অর্জন।[১] মূলত দীক্ষা বা মন্ত্রদীক্ষা হলো হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ ধর্মের মতো ভারতীয় ধর্মে গুরু কর্তৃক শিষ্যকে মন্ত্র শিক্ষা দেওয়ার রীতি। সাধারণত দীক্ষা গ্রহণ অনুষ্ঠানে গুরুর আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলা গ্রহণ অন্তর্ভুক্ত থাকে।[২]
দীক্ষা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত মূল "দা" (দিতে) ও "কসি" (ধ্বংস) থেকে অথবা পর্যায়ক্রমে ক্রিয়া মূল "দইক্সা" (পবিত্র করা) থেকে।[৩] দীক্ষার মাধ্যমে গুরু এবং শিষ্যের মন এক হয়ে যায়।[৪] দীক্ষার মাধ্যমে ঐশ্বরিক অনুগ্রহ দানকে কখনও কখনও শক্তিপাত বলা হয়।[৩]
একথা সর্বাংশে সত্য যে, ধর্ম মানে শুধুমাত্র আচার-আচরণের সমষ্টি নয়। ভগবানে বিশ্বাসীদের কাছে ধর্মের যে তাৎপর্য তা গভীর এবং ব্যাপক। এক্ষেত্রে গুরু তত্ত্বের ভূমিকাও অসীম। হিন্দু ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রচলিত প্রেক্ষিতে এই বিষয়টি নির্দেশ করেছেন লঘিমাসিদ্ধ যোগী (The Levitating Saint) ভাদুড়ী মহাশয়- মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ:
"ধর্ম তো কতকগুলি আচার-আচরণের সমষ্টি নয়। ভগবান্ই ধর্ম। আচার-আচরণগুলি তাঁকে সদাসর্বদা স্মরণ করিয়ে দেয় বলেই গৌণভাবে, আচার-আচরণকে ধর্ম বলে। ভগবান্ সর্বব্যাপী,সর্বান্তর্যামী, কোনও সময়ে তাঁর থেকে আমাদের বিচ্ছেদ নাই। কিন্তু হাতে বালা থাকলেও যদি সে বিষয়ে খেয়াল না থাকে, তবে তাকে খুঁজতে হয়, যতক্ষণ কেউ দেখিয়ে না দেয় খোঁজার অন্ত থাকে না, দেখিয়ে দিলে তখন নিজের অজ্ঞানতা ধরা পড়ে, পাবার যা তা পেয়ে সুখী হয়। তেমনি হারানিধি পাবার জন্য ভক্তের আকূতি জাগে, ব্যাকুলতা বাড়ে; তখন দয়ালু ভগবান্ কৃপা করে গুরুমূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে কৃপা করে নিজেকে নিজে দেখান।"
- এই হিসেবেই বলা হয়, দীক্ষার ক্ষেত্রে গুরু প্রাপ্তি আসলে ভগবান-এর কৃপা প্রাপ্তি।
প্রকার
[সম্পাদনা]বিভিন্ন ঐতিহ্য ও সম্প্রদায় দীক্ষাকে বিভিন্ন উপায়ে অনুশীলন করে। দীক্ষা প্রধানত দ্বিবিধ বহির্দীক্ষা ও অন্তর্দীক্ষা। বহির্দীক্ষায় পূজা, হোম প্রভৃতি বাহ্যিক অনুষ্ঠান বিহিত; আর অন্তর্দীক্ষায় মানুষের কুন্ডলিনীশক্তির (আত্মশক্তি) জাগরণ ঘটে। কোনো কোনো তন্ত্রে ত্রিবিধ দীক্ষার কথা বলা হয়েছে, যথা শাম্ভবী, শাক্তী ও মান্ত্রী।[৬] তন্ত্র পাঁচ ধরনের দীক্ষার কথা উল্লেখ করে: সমায়-দীক্ষা (আচারের সহিত সম্পন্ন করা হয়); স্পর্শ-দীক্ষা (আচার ছাড়া সম্পন্ন করা হয়); যোনি-দীক্ষা (শব্দ বা মন্ত্র দ্বারা সম্পন্ন হয়) ; সম্ভভি-দীক্ষা (গুরুর বাহ্যিক রূপের উপলব্ধি থেকে উদ্ভূত হয়) এবং মনো-দীক্ষা (যখন দীক্ষা মনের মধ্যে সঞ্চালিত হয়)।[৭] ইসকনের সদস্যদের জন্য প্রথম দীক্ষা, বা হরিনামা-দীক্ষা, অগ্নি বলির অংশ হিসাবে সঞ্চালিত হয় যেখানে উৎসর্গের জন্য খোলা আগুনে শস্য, ফল ও ঘি রাখা হয়।[৮] লাহিড়ী মহাশয়ের ঐতিহ্যে ক্রিয়া যোগে দীক্ষা দেওয়া হয়।[৯] বাঙালি সাধু আনন্দময়ী মা প্রায়ই স্পর্শ দীক্ষা (ঐশ্বরিক স্পর্শ) বা ড্রীক দীক্ষা (তার চেহারা দিয়ে) দিতেন, যেখানে তিনি শক্তিপাত (ঐশ্বরিক অনুগ্রহ) প্রদান করতেন।[১০] ভাদুড়ী মহাশয়-মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ শোনা যায় স্পর্শ দীক্ষা এবং দৃষ্টি দীক্ষা দুই দিতেন। অর্থাৎ তিনি স্পর্শ এবং দৃষ্টি দুইয়ের মাধ্যমেই শিষ্যদের ঐশ্বরিক অনুভব দান করতেন।
আরেক ধরনের দীক্ষা, সন্ন্যাসী আদেশে, ব্রহ্মচর্য, সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পদ ত্যাগ ও পারিবারিক বন্ধন সহ সমস্ত জাগতিক কর্তব্যগুলির ব্রত জড়িত। জৈনধর্মে দীক্ষার একই অর্থ রয়েছে। জৈনধর্মে দীক্ষাকে চারিত্রা বা মহানবিষ্ক্রমণও বলা হয়। হিন্দুধর্মে দীক্ষা নেওয়া ব্যক্তি এবং হিন্দু গোষ্ঠীর উপর নির্ভর করে বেশ কয়েকটি আচার অনুষ্ঠান সম্পাদন করা জড়িত।
বিভিন্ন তান্ত্রিক কাজ বিভিন্ন ধরনের দীক্ষা আচার গণনা করে:[১১]
- কৃয়াবতী
- কালাবতী
- বর্ণময়ী
- বেদময়ী
সকল বর্ণের হিন্দুরাই দীক্ষা গ্রহণের অধিকারী। কোনো কোনো তন্ত্রমতে দীক্ষাদানে নিজের মা সর্বোত্তম গুরু। দীক্ষাদানকারী গুরুকে কেন্দ্র করে কালক্রমে একেকটি সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। সম্প্রদায়গুলির নিজস্ব কিছু আচার-আচরণ থাকে যা একটি থেকে অপরটি ভিন্ন। বাংলাদেশে এরূপ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায়: অনুকূল সম্প্রদায়, মানিক সম্প্রদায়, মতুয়া সম্প্রদায়, জগদ্বন্ধু সম্প্রদায় প্রভৃতি। স্মৃতিনিবন্ধকার রঘুনন্দন বঙ্গদেশে তান্ত্রিক দীক্ষার প্রবর্তন করেন।[৬]
গুরুত্ব
[সম্পাদনা]বিষ্ণু যমলা (তন্ত্র) মতে, "যে প্রক্রিয়াটি দিব্য জ্ঞান (আধ্যাত্মিক জ্ঞান) প্রদান করে এবং পাপ ও অজ্ঞতার বীজকে ধ্বংস করে, সেই আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের দ্বারা দীক্ষা বলা হয় যারা সত্য দেখেছে।"[১২] জীব গোস্বামী[১৩][১৪] উল্লেখ করেছেন, “দিব্য জ্ঞানং যতো দদ্যাৎ কুর্যাৎ পাপস্য সংক্ষয়ম তস্মাৎ দীক্ষেতি সা প্রোক্তা দেশিকৈস্তত্ত্ব কোবিদৈ: (ভক্তি সন্দর্ভ-২৮৩)। যা থেকে অপ্রাকৃত দিব্য জ্ঞানের উদয় হয় এবং পাপের সর্বতোরূপে ক্ষয় হয়, তত্ত্বশাস্ত্রবিৎ পণ্ডিতেরা তাকেই দীক্ষা বলে বর্ণনা করেছেন। পারদের সংস্পর্শে রাসায়নিক ক্রিয়ার প্রভাবে কাঁসা যেমন সোনায় পরিণত হয়। তেমনি যথাযথভাবে দীক্ষা গ্রহণের ফলে মানুষ ব্রাহ্মণোচিত সমস্ত গুণাবলি অর্জন করেন।
আরো দেখুন
[সম্পাদনা]- ব্রাহ্মণ
- দ্বিজ
- উত্তীর্ণের অনুষ্ঠান
- পরম্পরা
- শক্তি
- তন্ত্র
- প্রাণপ্রতিষ্ঠা
- আদি শঙ্কর
- চৈতন্য মহাপ্রভু
- নিত্যানন্দ
- পঞ্চতত্ত্ব (বৈষ্ণবধর্ম)
- রামকৃষ্ণ পরমহংস
- সারদা দেবী
- স্বামী বিবেকানন্দ
- শ্যামাচরণ লাহিড়ী
- ভাদুড়ী মহাশয় - মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ
- বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী
- সন্তদাস কাঠিয়াবাবা
- পরমহংস যোগানন্দ
- মা আনন্দময়ী
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Monier-Williams Sanskrit-English Dictionary"। University of Cologne। পৃষ্ঠা d। জানুয়ারি ১০, ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৪-১৯।
- ↑ Coward, Harold G.; David J. Goa (২০০৪)। Mantra: hearing the divine in India and America। Columbia University Press। আইএসবিএন 978-0-231-12960-2।
- ↑ ক খ Grimes, John A. (১৯৯৬)। A concise dictionary of Indian philosophy। SUNY Press। পৃষ্ঠা 117। আইএসবিএন 978-0-7914-3067-5।
- ↑ "Archived copy"। ২০১১-০৩-১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-১১-২৬।
- ↑ ব্রহ্মচারী ( সংকলক ), শ্রীমদ্ ভক্তিপ্রকাশ (আগস্ট ২০১৪)। শ্রীশ্রী নগেন্দ্র উপদেশামৃত [ দ্বিতীয় খণ্ড ]। অধ্যাপক মনোরঞ্জন ঘোষ, শ্রী সবিতাদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, ২ বি রামমোহন রায় রোড, কলকাতা - ৯। পৃষ্ঠা ৫৯।
- ↑ ক খ দীক্ষা, সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
- ↑ The madness of the saints by June McDaniel, University of Chicago Press, (1989) p. 106 আইএসবিএন ০-২২৬-৫৫৭২৩-৫
- ↑ Introduction to New and Alternative Religions in America [Five Volumes]Eugene V. Gallagher, W. Michael Ashcraft (2006) Greenwood Publishing Group, p. 23 আইএসবিএন ০-২৭৫-৯৮৭১৩-২
- ↑ Yogananda, Paramhansa (২০০৩)। Autobiography of a Yogi। Sterling Publishers Pvt. Ltd। পৃষ্ঠা 102। আইএসবিএন 978-81-207-2524-9।
- ↑ Hallstrom, Lisa Lassell (১৯৯৯)। Mother of Bliss: Ānandamayī Mā (1896-1982)। Oxford University Press US। পৃষ্ঠা 140–144। আইএসবিএন 978-0-19-511647-2।
- ↑ Jnana Sankalini Tantra by Paramahamsa Prajnanananda
- ↑ Pandey, Vraj Kumar (২০০৭)। Encyclopaedia of Indian philosophy। Anmol Publications। আইএসবিএন 978-81-261-3112-9।
- ↑ Jiva Goswami
- ↑ "Life of Srila Jiva Goswami"। ২৩ মার্চ ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১।